বিশেষ প্রতিনিধি: বেলাল হোসেন সদ্য লেখাপড়া শেষ করা এক তরুণ। সবার মতো চাকরি বাজারের আগুনে লাফ দেন তিনিও। কোনো প্রকার ঘুষ ছাড়াই অবশেষে পুলিশের ৪০তম ক্যাডেট উপ-পরিদর্শক (এসআই-নিরস্ত্র) পদে চূড়ান্ত সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন বেলাল। দরিদ্র ঘরের সন্তান বেলালের পরিবারে আজ আনন্দের সীমা নেই। এই আনন্দ পরিপূর্ণ হতো যদি তার বাবা মজনু মিয়া বেঁচে থাকতেন। অভাবের সংসারে কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে পড়ালেখা চালিয়ে গেছেন তিনি। অবশেষে কোনো টাকা ছাড়াই পুলিশের চাকরিতে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। বেলালের মায়ের সংগ্রাম করা কষ্টের সংসারে এবার যদি একটু হাসি ফোটে। বেলাল বললেন, মাকে বলেছি– ‘তোমার ছেলে পুলিশের চাকরি পেয়েছে, আর কষ্ট করতে হবে না।’
আগামী ১৭ অক্টোবর সর্বশেষ মেডিকেল টেস্ট দিয়ে বেলালরা চাকরিতে যোগদান করবেন। রোববার সমকালের সঙ্গে কথা হয় তার। তিনি বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সময় মাঝেমধ্যে হতাশ হয়ে যেতাম। অনেক বড় ভাইকে দেখেছি চাকরি না পেয়ে হতাশ হতে, শুনেছি মামা–খালু ও টাকা ছাড়া এখন আর সরকারি চাকরি মেলে না। এসব দেখে পড়ালেখা ছেড়ে কোনো ছোটখাট চাকরিতে যোগ দিতে ইচ্ছা করত। কিন্তু মায়ের ইচ্ছায় সেটা করতে পারিনি। মা বলত, চাকরি না হোক কষ্ট করে যখন করেছ, পড়ালেখা শেষ করো, আল্লাহ একটা ব্যবস্থা করবেন। আজকে মায়ের কথাই সত্য হলো।’
দুঃখের স্মৃতি চারণ করে বেলাল বলেন, ‘আমি ছোট থাকতেই আমার বাবা মজনু মিয়া মারা যায়। পরে মা দুলালী বেগম দুই ভাই–বোনকে নিয়ে নানাবাড়ি আশ্রায় নেয়। সেখানেই বড় হয়েছি। কুড়িগ্রামের উল্লাপুরে একটি বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছি। আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে উঠি তার পর থেকেই টিউশনি করানো শুরু করি। সেই টাকায় মা ও বোনকে নিয়ে এক বেলা খেয়ে তো আরেক বেলা না খেয়ে কাটিয়েছি। এই অবস্থায় সেখান থেকে এসএসসিতে গোল্ডেন ‘এ প্লাস’ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি। এইচএসসিতে ভর্তি হয়েছিলাম এলাকায় একটি কলেজে। পারিবারিক চাপ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য কোচিং করতে হবে, এজন্য বেশি করে টিউশনি করাতাম টাকা জোগাড় করতে। এক দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চিন্তা, আর অন্য দিকে পারিবারিক চাপে পড়ালেখা একটু খারাপ হয়ে যাওয়ায় এইচএসসিতে ‘এ প্লাস’ ধরে রাখতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘অবশেষে ২০১৭–১৮ সেশনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তির সুযোগ হয়। এক ধরনের চাপমুক্ত হয়েছিলাম। এদিকে বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। বোন জামাই মা’কে দেখাশোনা করেন। কিন্তু তারপর আমার চাকরি নিয়ে নতুন চিন্তু শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ আমীর আলী হলে উঠি। আবার টিউশনি করানো শুরু করি। এ সময় পরিবারের খরচ চালিয়েছি আর চাকরির আবেদন করার জন্য কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। আল্লাহ রহমতে শুরুতেই পুলিশের চাকরিটা হয়ে গেল।’
বেলাল বলেন, ‘পুলিশের চাকরিতে আমার খরচ হয়েছে মোট আড়াই হাজার টাকা। ৫৪৫ টাকা আবেদন আর বাকি টাকা যাত্রায়াতে খরচ হয়েছে। দেশে চাকরি পেতে যে টাকা লাগে না, তা পুলিশে আবেদন না করলে জানতে পারতাম না। আমাদের মতো যাদের কেউ নেই, তাদের জন্য সরকারি চাকরির বিরাট সুযোগ তৈরি হয়েছে। কষ্টের সংসারে এবার যদি একটু হাসি ফোটে। সবার কাছে দোয়া চাই। দেশের সেবা যেন ঠিকমতো করতে পারি।’
বেলালের মতো এমন পুলিশে সুপারিশপ্রাপ্তের তালিকায় নিজের সিরিয়াল নম্বর দেখার অনুভূতি প্রকাশ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগ থেকে অনার্স পাশ করা মিলন পাল। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা–মা মৃৎশিল্পী। তারা দুজন মিলে মাটির জিনিস তৈরি করেন। পরে সেটা আবার গ্রামে গ্রামে ফেরি করে বিক্রি করেন। তিন ভাইবোনের পড়ালেখা খরচ বহন করতে গিয়ে বাবার নাভিরশ্বাস উঠে গেছে। বড় বোন কিছুদিন আগে একটি হাইস্কুলে চাকরি পেয়েছে। আমি পুলিশে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। সব ঠিকঠাক থাকলে প্রশিক্ষণের জন্য নিয়োগ পাবো। প্রশিক্ষণ শেষ করে যেখানে যোগদান করব, সেখানেই বাবা–মাকে নিয়ে চলে আসব। তাদের আর কষ্ট করতে হবে না আর। এ ছাড়া পুলিশের পোশাকে মহৎ কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারব, এটাই আমার কাছে স্বপ্নের মতো।’
টিউশনি করে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স করা রুমা আক্তারও ৪০তম ক্যাডেট উপ-পরিদর্শক পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা নেই। আট ভাইবোনের সংসার। দুই বোন এখনও অবিবাহিত। পরিবার থেকে আর্থিক সাপোর্ট পায়নি। কিন্তু তারা আমার আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছে। যদিও এইচএসসি পরীক্ষার পর থেকে টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ চালিয়েছি। আত্মবিশ্বাস ছিল এসআই পদে আমার চাকরি হবে। সে আত্মবিশ্বাস নিয়েই চাকরির জন্য আবেদন করি। এখন পুলিশের পোশাকে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োগ করতে চাই।’
পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পুলিশের ৪০তম ক্যাডেট উপ-পরিদর্শক (এসআই-নিরস্ত্র) পদে চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনলাইনে আবেদন আহ্বান করা হয়। সেখানে ৬২ হাজার ৩৪৩ জন প্রার্থী আবেদন করেন। এর মধ্যে প্রথম পাঁচটি ধাপ পার হতে পারে ১৮ হাজার ৮০৪ জন প্রার্থী। তারা সবাই লিখিত পরীক্ষার সুযোগ পান। এদের মধ্যে পাঁচ হাজার ৮৩৪জন উত্তীর্ণ হয়। পরে কম্পিউটার দক্ষতায় সেখান থেকে ঝরে পড়ে আরও ৮০৮ জন চাকরি প্রত্যাশী। পরে মৌখিক পরিক্ষা ও পুলিশ ভেরিফিকেশন। যাচাই–বাছাই প্রক্রিয়া শেষে ৯২১ জন প্রার্থী প্রাথমিকভাবে সুপারিশ করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৬৭ জন নারী সদস্য ও ৮৫৪ জন পুরুষ সদস্য রয়েছে।
আরও জানা গেছে, ৩০৭ জন ঢাকা, ১৪৯ জন চট্টগ্রাম, ৬৯ জন রাজশাহী, ১৩৮ জন খুলনা, ৪২ জন বরিশাল, ৩১ জন সিলেট, ৯৪ জন ময়মনসিংহ ও ৯১ জন রংপুর বিভাগ থেকে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
৪০তম ক্যাডেট উপ-পরিদর্শক (এসআই-নিরস্ত্র) পদে চূড়ান্ত সুপারিশপ্রাপ্ত সাগর কুমার বক্স পাবনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নগর ও অঞ্চল বিভাগে লেখাপড়া করেছেন। বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া এলাকার শান্তি কুমার বক্সের ছেলে তিনি। তার বাবাও একজন নিম্ন আয়ের কর্মচারী। সাগর কুমার বলেন, আমার বাবার পক্ষে টাকা দিয়ে চাকরি দেওয়া সম্ভব ছিল না। পুলিশের চাকরির মত সব ক্ষেত্রে যোগ্যতায় চাকরির সুযোগ হলে আমাদের মতো অনেক অস্বচ্ছল পরিবারের মুখে হাসি ফুটবে।
তাদের মতো কোনো টাকা খরচ না করেই চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন, মুক্তারুল ইসলাম, শিমুল সরকার, পরেশ চন্দ্র ও মিলন। এদের মধ্যে সুকেন বিশ্বাস ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। মৃতের চাচাতো ভাই অমিত বিশ্বাস বলেন, সুকেনের বাবা ফেরিওয়ালা। গ্রামে গ্রামে ফেরি করে চুড়ি-বয়লাসহ শিশু ও নারীদের প্রসাধনী বিক্রি করেন। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে এই পর্যন্ত আসছে সে। কিন্তু সুখের দেখা পেল না সুকেন।
পুলিশ সদরদপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, অনলাইনে যেকোনো প্রার্থী আবেদন পুলিশের চাকরির জন্য আবেদন করতে পারেন। পরে আবেদনকারীদের ১১টি ধাপ পার হয়ে চাকরিতে যোগদান করতে হয়। বর্তমানে পুলিশের চাকরিতে কোনো কোটা নেই। এ ছাড়া কোনো সুপারিশ করার সুযোগও নেই। সব কিছু অনলাইনের মাধ্যমে নিযোগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।