ডেস্ক নিউজ : এক দিনে রেকর্ডসংখ্যক উইকেটের পতন হয়েছে মিরপুরে, ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার দিনে বাংলাদেশকে লড়াইয়ে রেখেছে তাইজুলের দারুণ বোলিং।
দিনের খেলা শেষ হতেই ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে পিচের কাছে চলে গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাপোর্ট স্টাফের দুজন সদস্য। মাঠকর্মীরা তখন উইকেট ঝাড়ু দিচ্ছেন, প্রোডাকশনের কর্মীরা স্টাম্প তুলে নিচ্ছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার ওই দুজন তখন খুব কাছ থেকে পিচ পর্যবেক্ষণ করলেন গভীরভাবে। যেন বোঝার চেষ্টা করলেন, এই ২২ গজে আছে কী!
প্রথম দিনেই পতন হয়েছে ১৬ উইকেটের। মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের যা রেকর্ড। পিচের আচরণ নিয়ে তাই বাড়তি কৌতূহল থাকারই কথা। তবে উইকেট পতনের সংখ্যা দেখে যেমন মনে হয়, ততটা ভয়ঙ্কর নয় পিচ। তার পরও টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশের ইনিংস শেষ ১০৬ রানেই।
সেখানে উইকেটে প্রভাব যেমন কিছুটা আছে, এর চেয়ে বেশি আছে দক্ষিণ আফ্রিকার ভালো বোলিংয়ের ব্যাপার, আরও বেশি অবদান বাংলাদেশের বাজে ব্যাটিংয়ের। ৩০ রানের বেশি করতে পারেননি কোনো ব্যাটসম্যান, কোনো জুটি স্পর্শ করেনি ৩০। অন্তত পাঁচজন ব্যাটসম্যান উইকেট উপহার দিয়েছেন প্রতিপক্ষকে।
দিনশেষে তবু লড়াইয়ে প্রবলভাবেই আছে বাংলাদেশ। বোলারদের সৌজন্যে, বলা ভালো, তাইজুল ইসলামের দুর্দান্ত বোলিং দলের সম্ভাবনা জিইয়ে রেখেছে ভালোভাবেই। একটু এগিয়ে অবশ্য এখনও দক্ষিণ আফ্রিকাই। দিন শেষ করেছে তারা ৬ উইকেটে ১৪০ রান নিয়ে।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বোলার হিসেবে ২০০ উইকেটের মাইলফলকের দেখা পেয়েছেন তাইজুল। পরে পূর্ণ করেছেন ৫ উইকেটও
মিরপুর সবশেষ টেস্টেই গত ডিসেম্বরে নিউ জিল্যান্ড-বাংলাদেশ টেস্টের প্রথম দিনে উইকেট পড়েছিল ১৫টি। তখন সেটিই ছিল রেকর্ড। ওই পিচ ছিল একদম ‘মাইনফিল্ড।’ এই ম্যাচের উইকেট ততটা বিপজ্জনক নয়। তবে বোলিং বান্ধব উইকেট তো বটেই। স্পিনাররা টার্ন পেয়েছেন শুরু থেকেই। বিস্ময়কর ছিল, বাড়তি বাউন্স। পেসাররা অনেক বাউন্স পেয়েছেন, মিরপুরে যা সচরাচর মেলে না। স্পিনারদের জন্যও ছিল বাউন্স।
প্রোটিয়া পেসাররা সেই বাউন্স কাজে লাগিয়েছেন। নতুন বলে তারা সুইংও পেয়েছেন। প্রথম তিন উইকেট শিকার করেছেন ভিয়ান মুল্ডার। পরে তিন উইকেট নেওয়ার পথে কাগিসো রাদা পূর্ণ করেছেন ৩০০ টেস্ট উইকেট। বাঁহাতি স্পিনার কেশাভ মহারাজও নিয়েছেন তিন উইকেট।
বাংলাদেশের ইনিংসে মড়ক লাগে একদম শুরু থেকেই। নতুন বলে মূল হুমকি হওয়ার কথা রাবাদার। কিন্তু মিডিয়াম পেস বোলিং দিয়েই টপ অর্ডার কাঁপিয়ে দেন ভিয়ান মুল্ডার।
ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারে বিদায় নেন সাদমান ইসলাম (০)। মুল্ডারের অনেক বাইরের বল তাড়া করে যেভাবে আউট হন বাঁহাতি ওপেনার, সেটি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
কানপুরে সবশেষ টেস্টের মতো মুমিনুল হক আবার নামেন তিনে, নাজমুল হোসেন শান্ত চারে। এই দুজনও সাদমানের পথ ধরেন।
এলবিডব্লিউয়ের জোরাল আবেদনের পর মুমিনুল রক্ষা পান ইন্টারনেট বিভ্রাটের কারণে রিভিউয়ে বল ট্র্যাকিং দেখা না যাওয়ায়। একটু পরই উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান (৪)। মুল্ডারকে উইকেট উপহার দেন শান্তও (৭)। ফ্লিক করতে গিয়ে দৃষ্টিকটূভাবে মিড অফে ক্যাচ দেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
দুর্দান্ত বোলিং করেও প্রথম স্পেলে উইকেটের দেখা পাননি রাবাদা। পুরস্কার পান তিনি দ্বিতীয় স্পেলে। প্রান্ত বদলানোর পর প্রথম ওভারেই তার বিষাক্ত ইনকাটারে ছত্রখান হয়ে যায় মুশফিকুর রহিমের স্টাম্প (১১)।
রাবাদার টেস্ট ক্যারিয়ারের ৩০০তম উইকেট এটি। টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে কম ডেলিভারি (১১ হাজার ৮১৭ বল) করে মাইলফলকটি ছুঁলেন তিনি।
ওই স্পেলে লিটন দাসের উইকেটের দেখাও পান রাবাদা। চতুর্থ স্লিপে দুর্দানত ক্যাচ নেন ট্রিস্টান স্টাবস।
লাঞ্চের আগের শেষ ওভারে কেশাভ মহারাজের সোজা ডেলিভারিতে যখন এলবিডব্লিউ হন মেহেদী হাসান মিরাজ, বাংলাদেশ তখন ধুঁকছে ৬০ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে।
সেই ভোগান্তি থেকে আর মুক্তি মেলেনি। ওপেনিং থেকে এক প্রান্ত আগলে রাখা মাহমুদুল হাসান জয় ১২৮ মিনিট ক্রিজে থেকে আউট হন আলগা শটেই। জাকির হাসানের বদলে একাদশে ফিরে তিনি ৩০ রান করতে পারেন ৯৭ বল খেলে।
বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান হিসেবে একাদশে নেওয়ার পরও বিস্ময়করভাবে জাকের আলিকে নামানো হয় আট নম্বরে। তার অভিষেক ইনিংস শেষ হয় ২ রানেই।
একশ রানও তখন বাংলাদেশের জন্য বেশ দূরে। নবম উইকেটে ২৬ রানের জুটি গড়ে সেই দূরত্ব ঘোচান তাইজুল ও নাঈম হাসান। বাংলাদেশের ইনিংসর সর্বোচ্চ জুটি এটিই।
শেষ দুই উইকেট অবশ্য দ্রুতই পড়ে যায়। দশে নেমে তাইজুলের ১৬ রান দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোর।
বাংলাদেশ বোলিংয়ে নেমে সাফল্য পায় শুরুতেই। প্রথম ওভারেই দুর্দান্ত ডেলিভারিতে এইডেন মার্করামকে বোল্ড করে দেন হাসান মাহমুদ।
দ্বিতীয় উইকেটে ট্রিস্টান স্টাবস ও টোনি ডি জর্জি অবশ্য ভালো জুটি গড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। দিনের সবচেয়ে বড় জুটি তাদের হাত ধরেই আসে। কিন্তু তাইজুল বদলে দেন চিত্র।
স্টাবসকে ফিরিয়ে ৪১ রানের জুটি ভাঙেন তিনি। এরপর একের পর এক উইকেট এনে দিতে থাকেন তিনি এক প্রান্ত থেকে।
ডি জর্জির লড়িয়ে ইনিংস থামে ৩০ রানে, থিতু হতে পারেননি ডেভিড বেডিংহ্যাম। না বুঝে ছেড়ে দিয়ে শূন্য রানে বোল্ড হন অভিষিক্তি ম্যাথু ব্রিটস্কি।
রায়ান রিকেলটন অবশ্য এমন কঠিন উইকেটেও দারুণ খেলছিলেন। কিন্তু তার সম্ভাবনাময় ইনিংস থামে ২৭ রানে। ক্যারিয়ারে ত্রয়োদশ ৫ উইকেট পূর্ণ করেন তাইজুল।
আলোর স্বল্পতায় দিনের খেলা শেষ হয় ৬ ওভার আগে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৪০.১ ওভারে ১০৬ (জয় ৩০, সাদমান ০, মুমিনুল ৪, শান্ত ৭, মুশফিক ১১, লিটন ১, মিরাজ ১৩, জাকের ২, নাঈম ৮, তাইজুল ১৬, হাসান ৪*; রাবাদা ১১-৪-২৬-৩, মুল্ডার ৮-৪-২২-৩, মহারাজ ১৬.১-৪-৩৪-৩, পিট ৫-১-১৯-১)।
দক্ষিণ আফ্রিকা ১ম ইনিংস: ৪১ ওভারে ১৪০/৬ (মার্করাম ৬, ডি জর্জি ৩০, স্টাবস ২৩, বেডিংহ্যাম ১১, রিকেলটন ২৭, ব্রিটস্কি ০, ভেরেইনা ১৮*, মুল্ডার ১৭*; হাসান ৮-১-৩১-১, মিরাজ ১০-০-৩৩-০, তাইজুল ১৫-২-৪৯-৫, নাঈম ৮-০-২০-০)।