1. admin@channel7bangla24.com : admin :
সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৬ অপরাহ্ন

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ সজিবের পরিবারের খোঁজ-খবর নেয়নি কেউ

নিউজ ৭ বাংলা ডেস্ক :
  • প্রকাশের সময় : শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
  • ৩০ বার পঠিত

রায়েজুল আলম,শরীয়তপুর: বাবা আসবে এমন অপেক্ষায় প্রতিদিনই পথ চেয়ে থাকে সজিবের ৩ বছরের ছেলে আব্দুর রহমান। কেউ দরজায় নক করলেই মনে করে আব্দুর রহমানের বাবা চলে আসছে। দৌড়ে যায় দরজা খুলতে। মাকে ডেকে বলে মা, বাবা আসছে। দরজা খুলে দাও। মা দরজা খুলতেই বাবাকে না দেখতে পেলেই মুখ গোমরা করে বলে বাবা কখন আসবে? আমার বাবা কোথায় গেছে? অসহায় সজিবের স্ত্রী সন্তানদের মিথ্যা শান্তনা দিয়ে বলে যাচ্ছে তোমার বাবা অনেক দুরে গেছে, ক’দিন পর’ই চলে আসবে।

আব্দুর রহমানের বাবা সজিব হাওলাদার জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নিখোঁজ হন। পরে তার মরদেহ পাওয়া যায় নারায়ণগঞ্জের
শীতলক্ষ্যা নদীতে। এরপর থেকে আব্দুর রহমান ও আহাদকে কোলে নিয়ে আদর করেনি বাবা সজিব হাওলাদার, নেয়নি কোনো খবরও। একই ভাবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত সজিব হাওলাদারের অবুঝ সন্তান ও পরিবারের খোঁজ নেয়নি কেউই।শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর থানার চরকুমারিয়া ইউনিয়নের মাঝিকান্দি গ্রামে গিয়ে শহীদ সজিবের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।

সজিবের পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নজরুল হাওলাদারের দ্বিতীয় স্ত্রী রেহানা বেগমের ঘরে জন্ম সজিব হাওলাদারের। জন্মের পরে মায়ের বুকের দুধপান ছাড়ার আগেই পারিবারিক কলহে রেহানা শিশু সজিবকে রেখে অন্যত্র চলে যায়। এরপর নজরুল হাওলাদারের প্রথম স্ত্রী সেলিনা বেগম সজিবকে বুকের দুধপান করিয়ে নিজের সন্তানের মতো লালন-পালন করেন।
সজিবের উন্নত ভবিষ্যতের জন্য সেলিনা বেগম তাকে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করেন। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার পরে সজিব পালিয়ে ঢাকায় গিয়ে খাবার হোটেলে কাজ নেয়। এরপর সেখানেই বড় হয়ে সজিব ২০১৭ সালে চাঁদপুর জেলার হাইমচর ভৈরবী গ্রামের হযরত আলীর মেয়ে রাবেয়াকে বিয়ে করেন। বিয়ের পরে সজিব হোটেলের কাজ ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে যাত্রাবাড়ি এলাকায় ভ্রাম্যমান হিসেবে চা বিক্রির পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসা শুরু করেন। এরই মধ্যে সজিব ও রাবেয়া দম্পত্তির ঘর আলো করে জন্ম হয় আব্দুর রহমান (৩) ও আহাদ (১১ মাস) নামে দুই সন্তানের। স্ত্রী-সন্তান ও দুধ মা সেলিনাকে নিয়ে বেশ ভালোই কাটছিল সজিবের সংসার।

সজিব রাজধানীর ডেমরা থানার মিরপাড়া স্টাফ কোয়াটারের মারিয়া কমিউনিটি সেন্টারের ৬ষ্ট তলায় ভাড়া থাকতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক পর্যায়ে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে রূপ নিলে সজিব আন্দোলনকে সমর্থন দেন। কাজের ফাঁকে প্রতিটি কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিল সে। চা বিক্রয়ের ফাঁকে আন্দোলরত ছাত্র-জনতার মধ্যে পানি, চা ও বিস্কুট বিতরণ করত সজিব। সজিবের বড় ভাই রানা মিরপুরের একটি কলেজের ছাত্র হিসেবে প্রতিদিনই আন্দোলনে যোগ দিতেন। ৫ আগস্ট বেলা ১১ টা পর্যন্ত সজিবকে আন্দোলনকারীদের সহযোগিতা করতে দেখা যায়। এরপর সে নিখোঁজ হলে অনেক খোঁজাখুজি করেও কোনো সন্ধান পায়নি পরিবারের সদস্যরা। এরপর নিখোঁজের ১০ দিন পরে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে সজিবের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে সোনারগাঁও থানা পুলিশ। মরদেহর জিন্সের প্যান্টে থাকা একটি মোবাইল ফোন থেকে সজিবের পরিবারকে খুঁজে বের করে পুলিশ। পরে তাকে শরীয়তপুরের গ্রামের বাড়িতে এনে দাফন করা হয়।

সজিবের পরিবারের দাবি আন্দোলনের শেষ দিন সজিব পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর তাকে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর সজিবের অবুঝ দুই সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে অসহায় মা রেহানা বেগমকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিন্তু এখনো সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান সজিবের পরিবারের খোঁজ নেয়নি। সজিবের ভাই রানা হাওলাদার বলেন, আমিও আন্দোলনে ছিলাম।
নিখোঁজের তিন দিন আগে মায়ের সাথে কথা হয়েছে বাড়িতে আসব। কিন্তু আর আসা হয়নি। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পরে আমরা সজিবকে অনেক খোঁজাখুজি করেছি। কিন্তু কোথাও পাইনি। নিখোঁজের ১০ দিন পরে নারায়ণগঞ্জে তার মরদেহ পেয়েছি। আমার ছোট ভাইর দুইটি ফুটফুটে বাচ্চা রয়েছে। তার সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু এখন আমার পরিবার পুরো হতাশায় ভুগছে। কেউ আমাদের কোনো খবর নেয়নি। আমার ভাই হারিয়ে ফেলছি কিন্তু ওর দুইটি বাচ্চা আছে।

সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান অবুঝ বাচ্চা দুইটির মুখের খাবার ও পড়াশোনার দায়িত্ব নিলে ভবিষ্যত অন্ধকারটা আর থাকত না।
সজিবের স্ত্রী রাবেয়া বেগম বলেন, আব্দুর রহমান ও আহাদের বাবা মায়ের বুকের দুধ ছাড়ার আগেই এতিম হয়েছে। আমার দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে সব সময় জানতে চায় ওর বাবা কোথায় গেছে কখন আসবে। আর ছোট ছেলেটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বাবা বাবা ডাকতে শুরু করেছে। আমি তাদের প্রতিদিনি মিথ্যা শান্তনা দিয়ে বলি তোমার বাবা বেড়াতে গেছে। ক’দিন পর’ই চলে আসবে। এ রকম ভাবে প্রতিদিনই আমার সন্তানদের মিথ্যা শান্তনা দেওয়া ছাড়া আর কি করার আছে? বর্তমানে আমার মায়ের আয় থেকে দুই সন্তান নিয়ে কোন রকম দিন পার করছি। আপনারা জানেন একজন চা বিক্রেতার কী পুঁজি থাকে? আমার পরিবারও গরীব। এখনো আমার মা প্রতিদিন কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হয়।

তার (সজিব) অনেক ইচ্ছে ছিল নিজের দুই সন্তানকে পড়াশোনা করাবেন। কিন্তু এখন এটা কী হলো? বাচ্চাদের যে বয়স, ওদের রেখে তো আমার কাজে যাওয়া সম্ভব নয়। এখন তো ওদের খাবারসহ অন্যান্য খরচও বন্ধ। যদি সরকার বা কেউ এতিম দুইটি বাচ্চার খাবারসহ পড়াশোনার দায়িত্ব নিতো, তবে তার (সজিবের) স্বপ্ন পূরণ হতো। দেশের মানুষের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে আমার স্বামী অবুঝ দুই সন্তানকে এতিম করেছে। আমি চাই এতিম দুইটি বাচ্চার দায়িত্ব নিয়ে আমার স্বামীর স্বপ্ন পূরণ করে দিবে দেশের সরকার ও মানুষ। এছাড়া আমার কিছু চাওয়ার নেই। নিহত সজিবের দুধ মা সেলিনা বেগম বলেন, সজিবকে আমি নিজের পেটের সন্তানের মতো করে বুকের দুধপান করিয়েছি। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে সজিব পালিয়ে ঢাকা চলে গেছে। এরপর সে নিজে বড় হয়ে আয় করা শেখার পরে বিয়ে করেছে। আমার সজিব ১০-১৫ পর পর আমাকে দেখতে বাড়িতে আসত। আমার খরচ দিতো, খবর নিতো।

আমার ফুটফুটে দুইটি নাতি। অনেক স্বপ্ন ছিল আমার বাবার। কিন্তু বাবা এখন আমার কবরে শুয়ে আছে। কে দেখবে আমার নাতিদের, কে নিবে আমার খবর? কার কাছে বলব আমি দুঃখের কথা? আমার সব শেষ হয়ে গেলো। আমি দাবি জানাই, সরকার বা কেউ আমার নাতি ও ছেলে বউয়ের খাবারসহ পড়াশোনার দায়িত্ব নিবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ একটু উঁকি দিয়েও আমাদের খবর নিলো না। আামরা গরীব মানুষ, কেউ কী আসবে আমাদের খবর নিতে? কেউ কী সজিবের সন্তানদের কোলে নিয়ে আদর করে দায়িত্ব নিবে?

চরকুমারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আয়েশা বেগম বলেন, সজিব হাওলাদার নিতান্ত গরীব পরিবারের সন্তান। ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে। ঢাকায় সে চা বিক্রি করত। তার দুইটি সন্তান রয়েছে। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সজিব ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেছে। তাকে গত মাসে শরীয়তপুরের গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে।

মো: রায়েজুল আলম
শরীয়তপুর প্রতিনিধি

Facebook Comments Box
সংবাদটি শেয়ার করুন :
এ জাতীয় আরও খবর

ফেসবুকে আমরা