ড. মাহবুব হাসান : গ্রামে একটি প্রাবাদিক কথা চালু আছে। ক্ষেতের ফসল রক্ষার বেড়ায় যদি শস্য খেয়ে ফেলে, তাহলে উৎপাদক কৃষক কার ওপর ভরসা করবে? প্রবাদ হচ্ছে সত্যের সংহত রূপক। বেড়ায় ক্ষেত খেয়েছে বা ফসল খাচ্ছে- এ প্রবাদটি আমরা ব্যাংকিং খাতের জন্য প্রশাসন ও সরকারি দফতরের বিপরীতেও এ রক্ষক হয়ে ভক্ষকের চরিত্রে ঢুকে পড়াটাও লক্ষ্য করছি। বহু উদাহরণ দেওয়া যায়। তার মধ্যে সব থেকে বড় উদাহরণ হতে পারে সরকার নিজেই।
সরকার নিজেই দেশের গণমানুষের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছেন না। সেটা স্বীকার করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি প্রকাশ্যে বললেও শিল্পমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বলছেন না যে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন, তারা সেই ঋণ ফেরত দিচ্ছেন না। ২০১০-এ যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতার প্রথম বছর কাটায় তখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার কোটি টাকা। মাত্র ১২-১৩ বছরে সেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা।
তার মানে গত ১৪-১৫ বছরে সোয়া লাখ কোটি (প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা) টাকা ঋণ খেলাপির পেটে গেছে। এ খেলাপিদের তালিকা করে প্রকাশ করলে কি শিল্প ও ব্যবসা খাতে ধস নামবে? আর সে কারণেই কি সরকারের শিল্পমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী তাদের ইজ্জত রক্ষার জন্য খেলাপিদের আয়েসে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেননি? এই খেলাপিরা কেবল দেশের শিল্পপতি, বড় ব্যবসায়ী? আমদানিকারক, রফতানিকারকও কি সেই তালিকায় আছেন? এবং সরকার নিজেও তো ঋণ খেলাপি! নয় কী?
বুঝে দেখুন, ১৯৭২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৩৮ বছরে যারা ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি, হজম করেছে ২১ হাজার কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে বাদবাকি ঋণ নিয়ে তা খেলাপি করে হজম করেছে। সরকার বা সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মহাব্যবস্থাপকরা তাদের দেওয়া ঋণ ফেরত আনতে পারছেন না। বলা যায় ফেরত তারা আনছেন না। কেন তারা আনতে পারছেন না, কেন তারা আনেন না, সেই অনীহার একটি কারণ নিচে উদ্ধৃত রিপোর্টে মেলে।
‘অগ্রণী ব্যাংকের মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর শাখার মাধ্যমে এলসি (ঋণপত্র) খুলে গাড়ি আমদানি করেন আসাদুজ্জামান সোহাগ নামে এক ব্যবসায়ী। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত আমদানি নিবন্ধন সনদ (আইআরসি) তার নয়। আদনান এন্টারপ্রাইজের আইআরসি ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে তাকে আমদানির সুযোগ করে দেন ব্যাংকের ওই শাখার তখনকার ব্যবস্থাপক আরকানুল হক। আবার এলসি মার্জিন (আমদানি পণ্যমূল্যের একটি অংশ) জমা রাখার নিয়ম থাকলেও তিনি কিছুই রাখেননি। আর্থিক সুবিধা নিয়ে অবৈধ এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসার এক পর্যায়ে তিনি আর হিসাব মেলাতে পারেননি। এক পর্যায়ে ধরা পড়ে বিষয়টি। তদন্তে বেরিয়ে আসে, গ্রাহকদের এলসি মার্জিনের ১৫ কোটি ১৬ লাখ ৩১ হাজার ৮৫ টাকা আত্মসাৎ করেছেন ওই ব্যাংক কর্মকর্তা। সেই সঙ্গে তিনি বন্দর থেকে পণ্য ছাড় করার জন্য সোহাগকে অন্য গ্রাহকের জমা অর্থ থেকে ৭ কোটি টাকা দিয়েছেন।
এছাড়া অন্তত ১৬টি এলসি পণ্যের দাম (৯ কোটি টাকার বেশি) পরিশোধ করা হয়নি। এ ঘটনার পর প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পাওয়ায় আরকানুল হককে সাময়িক বরখাস্ত করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তাকেসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ব্যাংকের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়। আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার সমকালকে বলেন, অনৈতিক আর্থিক সুবিধার জন্য অবৈধ এ কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা। মানুষ ভরসা করে ব্যাংকে টাকা রাখেন, সেখানে এমন কাণ্ড ঘটলে তা খুবই উদ্বেগজনক। (সমকাল-২১/১০/২৩)
এক গ্রাহকের সনদ দিয়ে আরেকজনের পণ্য আমদানি, মার্জিন না রেখেই খুলেছেন একের পর এক এলসি এবং বিভিন্ন গ্রাহকের ১৫ কোটি আত্মসাৎ- এগুলো যদি একজন ব্যাংক ব্যবস্থাপকের নিয়মিত কাজ হয়, তাহলে আমানতকারী কি তাদের কাজে আস্থা রাখবেন বা বিশ্বাস করবেন। ব্যাংকে টাকা রেখে যদি ভরসা করতে না পারে কোনো গ্রাহক, তাহলে একেই বলে বেড়া হয়ে বা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের কর্তারাই তাদের আমানত বেহাত করে দিচ্ছেন। এই যে অবৈধ কাজ তার জন্য ব্যবস্থাপককে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, কিন্তু যাদের টাকা বেহাত হয়ে গেছে, তারা কি ফিরে পাবেন তাদের গচ্ছিত অর্থ?
এই উদাহরণ মাত্র একটি। প্রত্যেকটি ব্যাংকের শত শত বা হাজার হাজার শাখা আছে দেশজুড়ে। প্রত্যেক শাখায়ই কম আর বেশি যদি এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে কি আমানতকারীদের ভরসা ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর থাকবে? এ ব্যাংকটি অগ্রণীর, মানে সরকারি ব্যাংক। সরকারি ব্যাংকে বেসরকারি অনেকেই পরিচালকের চেয়ারে নিয়োগ পান। তাদের অধিকাংশই তার ও পরিবার-পরিজন এবং বন্ধু-বান্ধবের আবেদনে সাড়া দিয়ে কোটি কোটি টাকার ঋণ নিতে সাহায্য করেন।
আমাদের চেনা জানা অনেকেই টাকার কলা গাছ বনে গেছেন ব্যাংকের পরিচালক হয়ে। আর যারা শত শত বা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয় ও সেই ঋণের টাকা ফেরত দেয় না, শেষাবধি খেলাপির খাতায় নাম উঠিয়ে দিব্বি ঘুরে বেড়ায় সরকারের/ব্যাংকের রথি/মহারথিদের চোখের সামনে, তাদের কিছুই হয় না। এবং আর্থিক বছর শেষে ঋণ অবলোপনের সুযোগ নেন। কিন্তু গ্রামের কোনো কৃষক বা দোকানদার বা খামারি যদি টাকা ঋণ নেয়, দিতে না পারলে তাকে জেলের ঠিকানায় পাঠাতে কষ্ট হয় না ওই ব্যাংকারের। কিন্তু কাগজপত্র নকল হলেও বা ভিন্নজনের কাগজের বিপরীতে ঋণ দিতে তাদের কোনো ভয় জাগে না।
কারণ তারা জানে, ভুয়া কাগজের ঋণের মালিক, ঘুসে সয়লাব করে দিতে পারে বলেই দোষীদের আটকের চিন্তাও করেন না তারা। এটা করার সুযোগ পায় এ-কারণে যে ব্যাংক ব্যবস্থার যে আইন তাতে এমন সব সূক্ষ্ম ও খালের মতো দৃশ্যমান খাদ রয়েছে বা রাখা হয়েছে, যাতে ঋণীরা পার পেতে পারেন। আসলে যারা ব্যাংক খাতের আইন প্রণয়ন করেছেন তারা তাদের শ্রেণির জন্য ও ওপরের শ্রেণির খাদকদের সুবিধা ভোগের সুযোগ রেখেই আইন তৈরি করেছেন।
ঋণখেলাপিদের ইচ্ছাকেই যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে দুর্নীতির মূলোৎপাটন সম্ভব নয়। মুন্সিগঞ্জের অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক যদি নিজ ইচ্ছায় ওই পরিমাণ অর্থ লুটে নিতে পারেন, তার কয়েকজন সহযোগী নিয়ে, তাহলে কী আমরা ব্যাংকারদের কাছে নিজেদের জমানো অর্থ জমা রেখেছি এভাবে লুটের জন্য? এই সাহস সে/তিনি পেলেন কি করে? তার সাহসটা জুগিয়েছেন তাদের অধিকর্তারা। আবার ওই সব হাই অফিসিয়ালদের সাহস জুগিয়ে চলেছেন সরকারি দলের এমপিরা। তারা আইন সংস্কার করে লুটেরাদের স্বপ্ন আরও এক গজ বাড়িয়ে দিয়েছেন, যা আজ আর্থিক খাতের ঋণের মাধ্যমে লুটের দিগন্ত উন্মুক্ত করেছে।
আমাদের জাতীয় সংসদের মাননীয় সংসদ সদস্যরা ব্যাংক আইনের সংশোধন পাস করেছেন যেখানে উদ্যোক্তা পরিচালকরা ৬-৭ বছর থাকতে পারবেন, এই বিধান রেখে। তাদের কাজই হলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা এবং অন্য ব্যাংক থেকে তারা ঋণ নেওয়া। আমানতকারী জনগণের অর্থ এমন খোলামকুচির মতো ব্যবহার পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে পাওয়া যায় না। তার মানে আমাদের সংসদ সদস্যরা জনগণের জন্য নয় ধনীদের জন্যই কাজ করেন এবং তারাও ওই সামাজিক শ্রেণির মানুষ। কৃষকের জন্য তারা কিছু করেন না।
এই যে সুযোগসন্ধানী ও সুবিধাভোগী শ্রেণি, ঋণ খেলাপি এবং আত্মউন্নয়নকারী ধনিকশ্রেণি, এরাই দেশের শিল্পখাত ও বাণিজ্য খাতের অধিপতি দেবতা। এই দেবতাদের ওপর সরকার চাপ প্রয়োগ করতে পারেন না বলেই আর্থিক খাতের এতো দুর্দশা। এস আলম এবং তার গ্রুপ এবং তার ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা ওয়ান বিলিয়ন টাকা কেমন করে নিয়েছে, সেই তথ্য আজও প্রকাশ পায়নি। উচ্চআদালত থেকে দুদককে তদন্তের নির্দেশ দিলে তারা সেই কাজে নেমেছিল, কিন্তু দেবতাদের যিনি দেবীশ্রেষ্ঠা, তার ইঙ্গিতেই সব স্থগিত হয়ে গেছে।
পি.কে হালদার পালিয়ে ভারত যাওয়ার পর ভেবেছিলেন তিনি পার পেয়ে যাবেন। কিন্তু সেখানে আইনের লোক ও সৎ মানুষের অভাব নেই। ধরা খাওয়ার পর তিনিও গড়গড় করে বলে দিয়েছেন পেছনের দেবতা দেবীদের লীলাখেলার কথা। তিনি যে ১৬ হাজার কোটি টাকা দিয়েছেন ক্ষমতার মগডালের অধিপতিদের, মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে, সে সবই ব্যাংক ও আর্থিক খাতের হোল ব্যবহার করে। আর ছোটখাটো হোল বা গর্ত ব্যাংক খাতকে কেবল দুর্বলই করেনি, নড়বড়ে করে দিয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলমান এ লুটেরা দিগন্তের রাশ তারা কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে টানবেন, সেটা তাদেরই খুঁজে নিতে হবে। আইএমএফ যে তাদের কিছু নির্দেশনা দিয়েছে, সেই পথ অনুসরণ করলে কিছুটা উপকার তো অবশ্যই হবে। ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা ফেরত আনাটা কষ্টকর বটে। ভোগীদের পেট চিরে তো আর টাকা বের করে আনা যাবে না।
প্রথমত ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের ক্ষমতা কমাতে হবে। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সুপারিশ অগ্রাহ্য করা জরুরি। তারা যদি ব্যাংকের এমডি বা ডিএমডিকে বা আরও নিচের কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার কথা বলেন, বিনয়ের সঙ্গে তাদের সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্ষমতার লম্বা হাতে হাতকড়া পরানোর ক্ষমতা দিলেই ঋণখেলাপিদের পেট চিরে টাকা ফেরত আনা সহজ হবে। এতে শিল্প সেক্টরে, ব্যবসায়ীদের আমদানি-রফতানি সেক্টরে কোনো খারাপ ঢেউ উঠবে না, এই সত্য স্বীকার করতে হবে। কিন্তু ব্যাংকাররা এবং অধিপতিদের ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ রক্ষার জন্য ওই কাজ করবে না।
ঋণখেলাপিদের ইচ্ছাকেই যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে দুর্নীতির মূলোৎপাটন সম্ভব নয়। মুন্সিগঞ্জের অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক যদি নিজ ইচ্ছায় ওই পরিমাণ অর্থ লুটে নিতে পারে, তার কয়েকজন সহযোগী নিয়ে, তাহলে কী আমরা ব্যাংকারদের কাছে নিজেদের জমানো অর্থ জমা রেখেছি এভাবে লুটের জন্য? এই সাহস সে/তিনি পেলেন কি করে? তার সাহসটা জুগিয়েছেন তাদের অধিকর্তারা। আবার ওই সব হাই অফিসিয়ালদের সাহস জুগিয়ে চলেছেন সরকারি দলের এমপিরা। তারা আইন সংস্কার করে লুটেরাদের স্বপ্ন আরও এক গজ বাড়িয়ে দিয়েছেন, যা আজ আর্থিক খাতের ঋণের মাধ্যমে লুটের দিগন্ত উন্মুক্ত করেছে।