আরিফুল হক : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে যখন সিনেমা বানানোর ঘোষণা এলো; তখন থেকেই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম সিনেমাটি দেখবো বলে। চার বছর অপেক্ষার পর মুক্তি পেলো–মুজিব: একটি জাতির রূপকার। কিন্তু নানা ব্যস্ততার কারণে যাওয়া হচ্ছিল না। এরমধ্যে একজন ফোন করে আমন্ত্রণ জানালেন সিনেমাটি দেখার জন্য। সব কাজের ব্যস্ততা ঝেড়ে ফেলে গত ১৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় হাজির হলাম বসুন্ধরার স্টার সিনেপ্লেক্সে। বিশেষ প্রদর্শনী বলে সবার মধ্যে একটি উৎসব উৎসব ভাব। আমি ছাড়া বেশিরভাগ দর্শকই সিনেমার বোদ্ধা। নির্ধারিত সময়ে শুরু হলো শো।
প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় নীল সাদা আকাশে উড়ছে বিশাল এক উড়োজাহাজ। বুঝে নিলাম ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রর্ত্যাবর্তনের দৃশ্য দিয়ে সিনেমার শুরু। এক সময় বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করলো বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী হাওয়াই জাহাজ। উড়োজাহাজটি মাটি স্পর্শ করতেই দৌড়ে গেলেন অসংখ্য মানুষ। দৃশ্যটি দেখানো হলো লং শটে। তার পরের শটটি দেখি ক্লোজে। আমরা দেখি প্লেনের দরজা খুলে গেছে, বঙ্গবন্ধু মানে আরেফিন শুভ দাঁড়ালেন সামনে। চোখে তার ছলছল করছে জল। চশমাটা খুলে বঙ্গবন্ধু তাকালেন সমবেত মানুষের দিকে।
আরেকটি ক্লোজ শটে ফুলের মালা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন তাজউদ্দিন মানে রিয়াজ, খন্দকার মোশতাকের চরিত্রকে রূপ দেওয়া ফজলুর রহমান বাবু, বঙ্গবন্ধুর বাবার শেষ বয়সের চরিত্র রূপায়ণ করা খায়রুল আলম সবুজ। সবার আগে দৌড়ে গেলেন তোফায়েল আহমেদ, সঙ্গে তাজউদ্দিন। তাজউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর গলায় পরিয়ে দিলেন ফুলের মালা। জড়িয়ে ধরলেন বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু উড়োজাহাজ থেকে নামলেন–প্রথমে হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন বাংলাদেশের মাটি। তারপর মাথা ছোঁয়ালেন দেশের মাটিতে। দৃশ্যটি দেখে আমার শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় রক্তকণিকায় অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে যায়। হলজুড়ে তখন পিনপতন নীরবতা। মনের মধ্যে কেউ যেন গাইতে থাকে ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’।
এরপরের দৃশ্য রেসকোর্স ময়দান মানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। এই দৃশ্যটা দেখে মনে হয়, বিমানবন্দর থেকে শেখ মুজিবের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত আসার দৃশ্যটি দেখানো উচিত ছিল। তাহলে হয়তো আরও বেশি ভালো লাগতো। তবে প্রথম দৃশ্য দেখেই মনে হয় পরিচালক সফল। তিনি আগামী দুই-আড়াই ঘণ্টা দর্শক ধরে রাখতে সক্ষম হবেন। হয়েছেও তাই। অন্তত আমার বেলায় তো অবশ্যই।
ঘটনা এগোতে থাকে শেখ ফজিলাতুন নেছার ধারা বর্ণনায়। এরপর সিনেমা চলতে থাকে ঘটনামাফিক। বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানা দিক তুলে ধরা হয় পর্দায়। দুয়েকটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। টুঙ্গিপাড়ার স্কুলের খেলার মাঠে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সামনে লাঠি খেলা দেখানোর পর কিশোর বঙ্গবন্ধু যেভাবে তাদের কাছে দাবি-দাওয়া তুলে ধরেছেন, দৃশ্যটি ভালো লেগেছে। রেনুর সঙ্গে খোকার বিয়ের দৃশ্যটি অসাধারণ। তরুণ মুজিব যখন কলকাতা গিয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করেন সেই দৃশ্যটিও মনে দাগ কেটেছে। সোহরাওয়ার্দী বলেন–গোপালগঞ্জের মুজিব। জবাবে মুজিব বলেন–টুঙ্গিপাড়ার মুজিব।
অসাধারণ দৃঢ়তা এবং বিনয় একই সঙ্গে ধরা পড়ে পর্দায়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পাকিস্তানি আর্মি। আরেফিন শুভর কী অসাধারণ অভিনয়! পাকিস্তান পার্লামেন্টের বাইরে সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানিদের দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা, সাহায্য চাইলেও নিরাপত্তারক্ষীদের কেউ এগিয়ে না আসা, পরে পার্লামেন্ট অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর আগুনঝরা ভাষণ। হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। বঙ্গবন্ধুকে নির্জন কক্ষে আটকে রাখার দৃশ্য–মন ছুঁয়ে যায়। ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পাকিস্তান বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বিমান থেকে লিফলেট ছড়াচ্ছে। এ দৃশ্যে তিশা, নুসরাত ফারিয়া, সাবিলা নূর–আবেগী করেছেন। বিজয়ের পর ভারতীয় আর্মির মেজর অশোকতারা গেলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারকে খবরটি জানাতে। সেই দৃশ্যটিও মুগ্ধকর। ১৫ আগস্টের নৃশংস কালো রাতের দৃশ্য নিয়ে কিছু বলার নেই। ভয়াবহতার সবটা কি আর ধরা যায় পর্দায়। বাষ্পরুদ্ধ চোখে নিমগ্ন পুরো মিলনায়তন।
সিনেমাজুড়ে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন আরেফিন শুভ। কোনো বিশেষণেই তার অভিনয়ের প্রশংসা ফুটিয়ে তোলা যাবে না। সোহরাওয়ার্দীর চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন তৌকির আহমেদ। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার চরিত্রে তুষার খান ছিলেন খুবই সাবলীল। আরেকজনের কথা না বললেই নয়। তিনি রাইসুল ইসলাম আসাদ। মাওলানা ভাষানীর চরিত্র অসাধারণভাবে জীবন্ত করে তুলেছেন তিনি। তাজউদ্দিনের চরিত্রে রিয়াজ অতটা ভালো করতে পারেননি। গাজী রাকায়েত একটি মাত্র দৃশ্যে ছিলেন। রেনুর দাদার চরিত্র। ফাটিয়ে দিয়েছেন এক দৃশ্যেই। বঙ্গবন্ধুর বাবার চরিত্র করেছেন দুজন, যুবক ও মধ্যবয়সের চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী, বৃদ্ধ বয়সের খায়রুল আলম সবুজ। চঞ্চল খুবই ভালো করেছেন। মহাত্মা গান্ধীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন একজন। তাকে চিনি না। ভারতীয় অভিনেতা হবেন তিনি। অসাধারণ অভিনয় করেছেন। তবে খুব বিনয়ের সঙ্গে একটি কথা বলতে চাই–অনেকেই হয়তো পছন্দ করবেন না কথাটি। কেউ কেউ রেগেও যাবেন। তবুও বলি, শেখ ফজিলাতুন নেছার চরিত্র নুসরাত ইমরোজ তিশা অতটা ভালো করতে পারেননি। তিশার কাছে আরও নিপুণ অভিনয় আশা করেছিলাম। আমার মনে হয়েছে তিশা তার গতানুগতিক অভিনয় থেকে নিজেকে ভাঙতে পারেননি।
মুজিব বায়োপিকের কিছু বিষয় এবং দৃশ্য নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন। তারা বলার চেষ্টা করছেন, কিছু দৃশ্য বাস্তবের সঙ্গে মিল নেই। আবার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সিনেমায় আসেনি। এ ক্ষেত্রে আমার মত হলো–মুজিবের মতো একটা পাহাড়সম ব্যক্তিত্বকে একটা সিনেমায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। কখনোই না। এই সিনেমাতেই এমন কিছু সিকোয়েন্স আছে, যা দিয়ে একটা গোটা সিনেমা বানানো সম্ভব। এছাড়া এটা একটি ফিচার ফিল্ম। ডকুফিল্ম নয়। সুতরাং ইতিহাস ঠিক রেখে কিছু দৃশ্য নাটকীয় করা যেতেই পারে। এটাই স্বাভাবিক।
সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন শ্যাম বেনেগাল। চার বছর আগে তিনি যখন এর কাজ শুরু করেন; তখন তার বয়স ছিলো ৮৫! আর যখন কাজ শেষ হয়; তখন তার বয়স ৮৯! এত বয়সে আর কোনো পরিচালক কোনো আন্তর্জাতিক সিনেমা বানিয়েছেন কি না আমার জানা নেই। খুব সম্ভবত না। শ্যাম বেনেগাল ২০০৬ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ভারতীয় রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। বয়সের কারণে রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও সিনেমা থেকে অবসর নেননি। অসাধারণ একটি সিনেমা বানানোর জন্য বিশাল ধন্যবাদ তিনি অবশ্যই প্রাপ্য। সেই সঙ্গে এই সিনেমার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ। ভালো করেছেন সবাই। অন্তত সবার মধ্যে নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা ছিল।