নিজস্ব প্রতিবেদক : গণ আন্দোলনে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ তাদের অভিযোগ আর প্রতিবাদ জানানোর জন্য বেছে নিয়েছে ফেইসবুক।
বৃহস্পতিবার নিজেদের ভেরিফায়েড ফেইসবুকে এক পোস্টে সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর ‘হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগকারীদের’ গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে দলটি।
দীর্ঘ ওই পোস্টে বলা হয়, “আমরা হুঁশিয়ার করে বলতে চাই, সাধারণ মানুষসহ আমাদের নেতাকর্মীদের হত্যা বন্ধ ও হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে বিচার করতে হবে এবং এখনই এই নারকীয় অত্যাচার, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।কেউ যদি মনে করেন অত্যাচার, নির্যাতন করে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দিবেন তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন।”
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র সরকারপ্রধান, যিনি ক্ষমতা ছাড়ার পর দেশ ছেড়ে পালানোর পথ বেছে নিয়েছেন।
শেখ হাসিনার মত আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেই দেশ ছেড়েছেন বলে খবর আছে। কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ও এমপি ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকিরা আছেন আত্মগোপনে।
আন্দোলনে প্রাণহানির ঘটনায় কয়েক ডজন হত্যা মামলা হয়েছে গত দুই মাসে। এর অনেকগুলোতেই শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের আসামি করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ তাদের ফেইসবুক পোস্টে বলেছে, “জানি আপনারা ভালো নেই। দেশের সার্বিক অবস্থা চারদিকে সবার মাঝে এক সংকটময় অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং দলের সভানেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা যে কোনো পরিস্থিতিতে আপনাদের পাশে আছেন এবং থাকবে ইনশাল্লাহ। আপনারা সবাই মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে দেশ ও দেশের জনগণের জন্য দোয়া করবেন।
“আপনারা সবই জানেন, সবই দেখেছেন। এখন হয়তো সবকিছু অনুধাবন করতে পারছেন, কি পরিস্থিতিতে দেশরত্ন শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছিলেন। ষড়যন্ত্রকারীরা আরও লাশ চেয়েছিলে। তিনি চাননি আর কোন বাবা-মায়ের বুক খালি হোক। তাই সময়ের প্রয়োজনে এই সাময়িক পদক্ষেপ নিয়েছেন।”
তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা ১৫ বছর বাংলাদেশ শাসন করা আওয়ামী লীগ বলছে, ছাত্রদের আন্দোলনের পিছনে ছিল ‘ক্ষমতা দখলের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’।
“আপনারা দেখেছেন ১৬ জুলাই থেকেই ছাত্রদের আন্দোলনকে হাইজ্যাক করে কিভাবে দেশের রাজনৈতিক অপশক্তি ও বিদেশি এজেন্টরা কিভাবে হত্যা ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। এমনকি ছাত্রদের ওপর ৭.৬২ রাইফেল ব্যবহার করে গুলি চালিয়ে পরিস্থিতিকে অগ্নিগর্ভ করে তোলা হয়। কিভাবে ঢাকা শহরে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা হয়েছে।”
সরকারপতনের পর গণভবনে লুপপাট, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্থাপনায় ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের প্রসঙ্গ ধরে ফেইসবুক পোস্টে বলা হয়, “আপনারাই ভেবে দেখুন, এইসব সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের সাথে কোটা আন্দোলনের কি সম্পর্ক ছিলো। যে পুলিশ বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে, পরিকল্পিতভাবে কিভাবে তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে এবং ৪৫০টি থানা ও অস্ত্রাগার লুট করা হয়েছে।”
দেশকে ওই অবস্থায় রেখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনার দেশ ছাড়ার ব্যাখ্যায় তার দল বলছে, “এর সবই ছিল ক্ষমতাদখলের একটি ষড়যন্ত্র। তখন সরকার আরও কঠোর হলে হয়তো আরও লাশ পরত, আরও অনেক বাবা-মায়ের বুক খালি হত। তাই মানুষের জানমাল রক্ষায় দেশরত্ন শেখ হাসিনা এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।”
আন্দোলন ঘিরে ‘পরিকল্পিতভাবে একের পর এক সহিংসতা’ তৈরি করা হয়েছে দাবি করে আওয়ামী লীগ বলছে, “আপনারা বুঝতে পারছেন, কেন সেন্টমার্টিন দ্বীপকে সংরক্ষিত করে কার্যত জনগণের যাতায়াতের জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
“কেন পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিকল্পিতভাবে একের পর এক সহিংসতা তৈরি করা হচ্ছে! বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আপনাদের আশ্বস্ত করছে, আমাদের বুকে এক বিন্দু রক্ত থাকতে বাংলাদেশের মাটিতে অন্য কোন দেশের ঘাঁটি হবে না।”
ফেইসবুকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, “এই দেশ বাঙালির ২৪ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল। অন্য কোনো দেশের পতাকা এই মাটিতে উড়তে দেওয়া হবে না। প্রয়োজনে আরেকটি যুদ্ধ হবে, স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ।”
সারাদেশে শিক্ষক সমাজকে ‘অপমান করা হয়েছে’ মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ বলছে, “অভিভাবকদের কাছে অনুরোধ, আপনারা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচান। শিক্ষার্থীরা এখন থাকবে ক্লাস ও শিক্ষাঙ্গণমুখী । কিন্তু এখনই তাদেরকে সচিবালয় এবং ক্ষমতামুখী করে পরিকল্পিতভাবে কেন ধ্বংস করা হচ্ছে? জাতি ধ্বংসের এই পরিস্থিতি চলতে দেয়া যায় না।”
অন্য কোনো দেশকে ‘বাংলাদেশে ঘাঁটি তৈরির সুযোগ করে দিতে’ পরিকল্পিতভাবে দেশে একটি অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছে আওয়ামী লীগ।
দলটি বলছে, “পাঁচই অগাস্টের পর দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর যেভাবে নির্মম হত্যাকাণ্ড, অত্যাচার ও নির্যাতন চালানো হয়েছে তা খুবই ন্যক্কারজনক ও নিন্দনীয় ঘটনা।”
হিন্দুদের ওপর নিপীড়ন, মাজার ভাংচুর, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলার প্রসঙ্গ ধরে ফেইসবুক পোস্টে বলা হয়, “এইসব কিসের লক্ষণ? এই সবকিছুর সুষ্ঠ তদন্ত ও দোষীদের বিচার অবশ্যই করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নতুবা উদ্ভূত পরিস্থিতির দায় এই অবৈধ ইউনূস সরকারকেই বহন করতে হবে।”
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ বলছে, “দেশে এ পর্যন্ত সংঘঠিত সকল হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ, ভাংচুর, আগুন সন্ত্রাস, নির্যাতন, চাঁদাবাজি, অবৈধ দখলের সুষ্ঠ তদন্ত সাপেক্ষে, সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব দিয়ে দোষীদের বিচার নিশ্চিত করুন। নতুবা আপনারাও এর দায় থেকে মুক্তি পাবেন না।”
পোস্টে বলা হয়, “আপনারা দেখছেন, প্রশাসনে কীভাবে পরিকল্পিতভাবে অসন্তোষ তৈরি করা হচ্ছে। ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন করায় কতজন আনসার সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে তা কোনো মিডিয়াও প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছে না।”
আন্দোলনে প্রাণহানির ঘটনায় যেসব হত্যা মামলা হচ্ছে, তার মধ্যে কয়েকটি মামলায় সাংবাদিকদের আসামি করার নিন্দা জানিয়েছে আওয়ামী লীগ।
ফেইসবুক পোস্টে তারা অভিযোগ করেছে, “এই সরকার মিডিয়া অফিস দখলে ইতোমধ্যে বিশ্ব রেকর্ড করেছে। এই পর্যন্ত সারাদেশে দেড় শতাধিক সাংবাদিকের নামে হত্যা মামলা দিয়েছে। তিন শতাধিক সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করেছে। এরাই আবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বড় বড় কথা বলে।”
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সমালোচনা করে ফেইসবুক পোস্টে বলা হয়, “তিনি বাংলাদেশের ইতিহাস মুছে ফেলার জন্য যতই রিসেট দেন না কেন, দেশের মৌলিক ও অস্তিত্বের ইতিহাসগুলো মোছার ক্ষমতা উনার নাই। মুছতে পারলেতো বাংলাদেশই থাকবে না।
“স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, ত্রিশ লক্ষ শহীদ, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, জাতির পিতা হচ্ছে বাংলাদেশের মৌলিক ভিত্তি, আমাদের জাতিগত অস্তিত্বের জায়গা। দেশকে তিনি শাসন শোষণ যাই করুন, এসব গৌরবময় অধ্যায় মেনে নিয়েই করতে হবে।”
সারা দেশে ‘সহস্রাধিক’ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে ‘হত্যা করা হয়েছে’ দাবি করে দলটি বলছে, “চাঁদাবাজি, বসতভিটা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল ও নির্যাতন করা হচ্ছে। সবই হচ্ছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। সাধারণ মানুষও চাঁদাবাজি ও নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।
“হ্যাঁ, কেউ যদি অপরাধী হয়, দেশের আইন অনুযায়ী এর বিচার হোক। আমাদের সরকারও দলীয় অনেক অপরাধীকে বিচারের আওতায় এনেছিল। সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখিয়ে সারাদেশে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আমরা তৈরি করেছিলাম। অপরদিকে, এই অবৈধ সরকার ক্ষমতা দখলের পরপরই দেশের সকল শীর্ষ সন্ত্রাসী ও আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত সকল জঙ্গিকে পুলিশ ও সেনাবাহিনী প্রহরায় মুক্তি দিয়ে আরও বেশি অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কারণ সন্ত্রাসীরা বুঝে গেছে, অপকর্ম করলে তাদের কোন শাস্তি হবে না “
আওয়ামী লীগ বলছে, “আওয়ামী লীগের শিকড় অনেক গভীরে, এই দেশের জন্মের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক। দেশের ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ এর স্বমহিমায় ফিরে আসবে, দেশের অসমাপ্ত উন্নয়নের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে একটি উন্নত জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবে।”