ফয়সাল আহমেদ : চুম্বকের আকর্ষণের মতো উত্তরবঙ্গের আলাদা একটা আকর্ষণ বা ‘টান’ আছে। এই ‘টান’ যারা উত্তরবঙ্গে নিয়মিত যাতায়াত করেন অথবা দীর্ঘদিন থেকে এখানে বসবাস করছেন তারা উপলব্ধি করতে পারেন। বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ কথাশিল্পী এক আড্ডায় বলছিলেন, বগুড়ার পর থেকে যখন গাইবান্ধা হয়ে তিনি আরো উত্তরে যাত্রা করেন, তখন খুঁজে পান গল্প আর গল্প! উত্তরের জনপদ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেকটা আলাদা। উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি, মাটি, ভাষা ও সংস্কৃতির পৃথক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ কারণেই কি আমাদের প্রধান প্রধান সাহিত্যিক উত্তরবঙ্গ থেকে এসেছেন? আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদুল জহির, মঞ্জু সরকার এবং জাকির তালুকদার উত্তর জনপদের মানুষ। উত্তরবঙ্গের মাটি ও মানুষকে নিয়ে এঁদের প্রত্যেকের কমবেশী গুরুত্বপূর্ণ লেখা রয়েছে।
আমাদের এবারের ভ্রমণ গন্তব্য নওগাঁ ও বগুড়া অঞ্চল। বন্ধু খোকন চাকরিসূত্রে নওগাঁ অবস্থানের কারণে আমরা বন্ধুরা মিলে একাধিকবার নওগাঁতে এসেছি। আমরা এখন যে ভ্রমণগল্প বলছি তা ইউসুফ ভাই, শামীম ভাই এবং সবুজ ভাইসহ নওগাঁ ভ্রমণের গল্প। খোকনের বাসায় থেকে আমাদের পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় ও অন্যান্য স্থান ঘুরে দেখার গল্প। আমরা যখন নওগাঁর বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের কাছে পৌঁছাই তখন রাত ৯টা পেরিয়ে গেছে। আহারপর্ব ও খানিকটা ব্যক্তিগত আড্ডা শেষে আমরা খোকনের সাথে উত্তরবঙ্গের ইতিহাস পাঠ নিয়ে বসি। ইতিহাস ও রাজনীতির নিবিষ্ট পাঠক খোকন জানায়, অতি প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন ও প্রত্মসম্পদে সমৃদ্ধ জনপদ নওগাঁ। ধারণা করা হয়, নতুন গাঁও বা নয়টি গ্রাম বা চক হতে নওগাঁ নামের উৎপত্তি। ১৮৬৬ সালে রাজশাহী জেলার অধীনে নূরুল্যাবাদে নওগাঁ মহকুমার পত্তন হয়। ১৮৮২ সালে মহকুমা স্থানান্তর করা হয় নওগাঁয়। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে নওগাঁকে জেলা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। নওগাঁজুড়ে রয়েছে প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন।
নওগাঁ সদরে আছে করোনেশন হল নামে একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য। ভারতবর্ষে এক সময় গাঁজা সেবন ও চাষ বৈধ ছিল। এই করোনেশন হল জেলা গাঁজা চাষীদের সমবায় গাঁজা সোসাইটির উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়। হলটি এক সময় মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয় হিসাবে ব্যবহৃত হতো। খোকন জানায়, প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদা শংকর রায় এক সময় নওগাঁ মহকুমার প্রশাসক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। গাঁজা সোসাইটির প্রচুর সম্পত্তি নওগাঁ শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এখন অবশ্য বারোভূতে লুটপুটে খাচ্ছে এইসব সম্পত্তি।
আমাদের প্রথম গন্তব্য বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্মসম্পদ পাহাড়পুর বা সোমপুর বৌদ্ধবিহার। জেলা সদর থেকে ২৭ কি.মি. দূরে বাদলগাছি উপজেলায় পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার অবস্থিত। ১৯০৪ সালে তৎকালীন ভারত সরকার পাহাড়পুর এবং এর পাশের সত্যপীর ভিটাকে ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি হিসাবে ঘোষণা করে। দীঘাপতিয়ার জমিদার শরৎকুমার রায়, তৎকালীন রাজশাহীর বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটিশ ভারতীয় প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে ১৯২৩ সালে পাহাড়পুরে প্রথম খননকাজ পরিচালনা করা হয়। দীর্ঘ প্রায় ১১ বছর খনন কাজের তত্ত্বাবধান করেন প্রখ্যাত প্রত্মতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক রাখাল দাস বন্দোপাধ্যায়, কে এন দীক্ষিত, জি সি চন্দ্র প্রমুখ। খনন কাজের পরে পাহাড়পুরের লুপ্তপ্রায় বৌদ্ধবিহার, সত্যপরীর ভিটা এবং সংলগ্ন তারা মন্দিরসহ অন্যান্য স্থাপত্য নিদর্শন ক্রমে উন্মোচিত হয়। ৭৭০ হতে ৮১০ সালের মধ্যে এই বৌদ্ধ মন্দিরটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। মন্দির চতুর্পাশে সুউচ্চ প্রাচীর দ্বারা মন্দিরটিকে সুরক্ষিত করা হয়েছে। প্রাচীর এবং মন্দিরসংলগ্ন ছোট কুঠুরী রয়েছে। ধারণা করা হয় এতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করতেন। মূল মন্দিরের উত্তর পার্শ্বে সিংহ দুয়ার আর পূর্বপাশে একটি সমাধিস্থল রয়েছে।
পাহাড়পুরের উঁচু ঢিবিতে দাঁড়িয়ে, যেটি ছিল পুরো বিহারটির কেন্দ্র, গোটা বিহারটি দেখা যায়। বাঙলার সর্ববৃহৎ ও প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সকলকে অভিভূত করে। সেই যুগে এখানে বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি দর্শন, শিল্পকলা, বিজ্ঞানসহ নানা বিষয়ে জ্ঞানচর্চা করা হতো! গুরুত্ব বিবেচনায় এটি ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান একটি প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কম্পাউন্ডের ভেতরেই প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি জাদুঘর বা সংগ্রহশালা আছে। এই সংগ্রহশালায় বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাচীন স্থাপত্যের নানা নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। এতে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, ইসলাম ধর্মাবলম্বীসহ তৎকালীন সভ্যতার সাধারণ মানুষের জীবনানুষঙ্গের পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে ধাতব মুদ্রা, মৃৎপাত্র থেকে শুরু করে তামাক সেবনের কল্কে পর্যন্ত সংরক্ষিত আছে। পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার দেখা শেষে সন্ধ্যায় আমরা খোকনের ডেরায় ফিরে আসি। রাতে চলে নানা বিষয়ে আলোচনা ও আড্ডা।
দ্বিতীয় দিন আমরা নওগাঁ থেকে সড়ক পথে প্রায় ৪০ কি.মি. দূরে মান্দা উপজেলাধীন কুসুম্বায় অবস্থিত ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ দেখতে যাই। সুবা বাঙলার সুলতান হুসেন শাহর পুত্র নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ নসরত শাহ গৌড়াধিপতি থাকাকালীন এই মসজিদ নির্মাণ করেন। কালো পাথর দ্বারা নির্মিত এই মসজিদটি ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদের দেয়ালে ফুল-ফল লতা পাতার চিত্র এবং আরবি ক্যালিগ্রাফি অঙ্কিত আছে। এর ভেতরে একটি মঞ্চ আছে যা কালো পাথরের পিলার ও ছাউনি দ্বারা নির্মিত। মসজিদের সন্মুখভাগে মহিলাদের নামাজ আদায় করার জন্য পৃথক গ্যালারী রয়েছে। মসজিদের আঙ্গিনার সঙ্গে সুবৃহৎ দীঘির পাড়ে বসে আমরা খানিকটা ক্লান্তি দূর করি। কুসুম্বা মসজিদের আঙ্গিনায় প্রতি শুক্রবার প্রচুর লোকজন তাদের মানত পূরণের জন্য শিরনি দিয়ে থাকেন। কুসুম্বা মসজিদ দেখা শেষে আমরা সন্ধ্যায় নওগাঁ শহরে ফিরে আসি। রাতে শামীম ভাই ও সবুজ ভাই ঢাকায় ফিরে যান। আমি ও ইউসুফ ভাই থেকে যাই আরো কিছু গন্ত্যবে যাওয়ার জন্য।
জেলা সদরের অদূরে অবস্থিত ভগ্নপ্রায় দূবলাহাটি এবং বলিহার রাজবাড়ী ঘুরে আসা যায়। ঐতিহাসিক কৈবর্ত বিদ্রোহের স্মারক ধীবর দীঘিও যাওয়া যায়। আমি ও ইউসুফ ভাই ধীবর দীঘি যাওয়া মনস্থ করি। খোকনের অফিস থাকাতে সে এই যাত্রায় ভ্রমণসঙ্গী হতে পারলো না।
নওগাঁ সদর হতে প্রায় ৫০ কি.মি. দূরে ধীবরদীঘি। আমরা সকালের নাস্তা সেরে বাসযোগে সাপাহারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাই। দুপুর ১২টায় পৌঁছাই সাপাহারে। সাপাহার থেকে একটি ভ্যান ভাড়া করে ধীবরদীঘি চলে আসি। সবুজ শ্যামল বিস্তীর্ণ প্রান্তরে বরেন্দ্রভূমির ভূমিপুত্র রোদ্রক পুত্র দিব্যক কর্তৃক পাল সাম্রাজ্যের অধীনস্ত থেকে বরেন্দ্রভূমির স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার স্মারক এই ধীবরদীঘি। ১০৭৫ সালে শুরু হওয়া কৈবর্ত বিদ্রোহের ফল হচ্ছে ১০৮২ সালে দিব্যকের রাজধানী গৌড়সহ বরেন্দ্রভূমির ক্ষমতা দখল। বিশাল দীঘির ঠিক মাঝখানে একটি অখন্ড শ্বেত পাথরের স্মারক ভাস্কর্য আজো কৈবর্ত বিদ্রোহের স্মৃতি বহন করে চলেছে।
দিব্যক ছিলেন জেলে বা ধীবর সম্প্রদায়ের নেতা। তাছাড়া এই বিদ্রোহে কৈবর্ত কৃষিজীবীরাও যুক্ত হয়েছিল। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, দিব্যক ছিলেন পাল রাজাদেরই একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজকর্মচারী। দ্বিতীয় মহীপালের সময় অতিষ্ঠ জনতা এবং আরো কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্তগোষ্ঠী নিয়ে দিব্যক লড়াই করে বরেন্দ্রভূমির দখল নেয়। দিব্যকের রাজত্বের সময় এই দীঘি এবং স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়। দিব্যকের মৃত্যুর পর তার ভাই রুদ্দোক এবং সর্বশেষ ভীম বরেন্দ্র অঞ্চল শাসন করে। কৈবর্তদের প্রায় ৩০ বছরের শাসনকালে তারা গণমানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। অবশেষে নানা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মধ্য দিয়ে পাল রাজারা পুনরায় বরেন্দ্রভূমির ক্ষমতা দখল পুনর্দখল করে। রামপালের সময় (১০৮২-১১২৪) পালরা আরো অন্যান্য সামন্তদের সহায়তায় কৈবর্তদের হাত থেকে বরেন্দ্রভূমি পুনর্দখল করে। এরপর ভীম এবং তার পরিবারের সকল সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
আমরা একটি নৌকা নিয়ে স্মারক স্তম্ভের কাছে যাই। ছুঁয়ে দেখি একটি অনন্য সাধারণ বিদ্রোহের স্মারক চিহ্নকে। ফেরার পথে একটি সাঁওতাল পল্লীতে যাই। সাঁওতালদের আতিথিয়েতা ও আপ্যায়ন আমাদের মুগ্ধ করে। এবার ফেরার পালা। নওগাঁগামী বাসের টিকেট কেটে কাউন্টারের লাগোয়া একটি রেস্তোরাঁয় অপেক্ষা করি। পরিচয় হয় স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাদের সাথে। তাদের সাথে আমাদের তুমুল চায়ের আড্ডায় কখন যে বাস ছেড়ে গেলো টেরই পাইনি! কী আর করা! এরপর লোকাল একটি বাস ধরে নওগাঁ ফিরি। নওগাঁ পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়।
আজ রাতেও আমাদের তিনজনে চলে অবিরাম আড্ডা। খোকনের ভাষ্যমতে, নওগাঁয় ঐতিহাসিক ও প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শনের অফুরন্ত ভাণ্ডার। সময় থাকলে জেলা সদর হতে ৫০ কি.মি. দূরে ধামুরহাট উপজেলায় অবস্থিত আলতা দীঘি এবং এর চারপাশের নয়নাভিরাম শালবন ঘুরে দেখা যেতো। আলতাদীঘি ভারত সীমান্তঘেষা একটি অঞ্চল। এখানে শীতকালে প্রচুর পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আমাদের এবার যাওয়া হলো না কবিগুরুর স্মৃতিধন্য পতিসর। আত্রাই থানা সদর হতে ৭ কি.মি. দূরে কালীগ্রাম ইউনিয়নে পতিসর। এখানে রবীন্দ্রনাথের কাছাড়ি বাড়ি ছিল। কালিগ্রাম পরগনাটি ঠাকুর পরিবারের জমিদারির অংশবিশেষ। এই পরগণার জমিদারী দেখাশোনা করার জন্য কবিগুরু বারকয়েক এখানে এসেছিলেন। এখানকার সাধারণ মানুষজনের সহজ সরল জীবন যাপন ও প্রাকৃতিক পরিবেশ কবিকে মুগ্ধ করেছিল। এই কালিগ্রামেই তিনি নোবেল পুরস্কারের টাকা দিয়ে গরিব কৃষকদের সহায়তার জন্য কৃষিব্যাংক স্থাপন করেছিলেন। এখানে কবির ব্যবহৃত কিছু আসবাব সামগ্রী রংক্ষিত রয়েছে। আর এই কুঠিবাড়ীর সামনে বিশাল বিশাল তালগাছ মনে করিয়ে দিবে ছোটোদের জন্য জনপ্রিয় একটি ছড়া ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/সবগাছ ছাড়িয়ে/উঁকি মারে আকাশে’।
আমরা রাতে খানিকটা আগেই শুয়ে পাড়ি। কাল আমি ও ইউসুফ ভাই মহাস্থানগড় যাত্রা করবো। মহাস্থানগড় দেখে বগুড়া থেকে ঢাকায় ফিরবো। সকালের নাস্তা সেরেই আমি ও ইউসুফ ভাই মহাস্থান গড়ের দিকে যাত্রা করি। খোকনও কর্মস্থল পল্লীবিদ্যুতের অফিসে রওয়ানা হয়ে যায়। উত্তরবঙ্গের গেটওয়ে বা প্রবেশদ্বার খ্যাত বগুড়া জেলার অবস্থান করতোয়া নদীর তীরে। বরেন্দ্র ভূমি ও পুন্ড্রবর্ধনই বগুড়ার প্রাচীন নাম বলেও ধারণা করা হয়। নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতকত পর্যন্ত এই অঞ্চল সেন বংশের অধীনে আসে। পরবর্তীতে তা মুসলমান শাসকদের করায়ত্ত হয়। বগুড়া উত্তরবঙ্গের একটি প্রসিদ্ধ শহর এবং ব্যবসায়িক মোকাম হিসাবে সুপরিচিত। সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবন শাহের পুত্র স্বাধীন বঙ্গের শাসক বগরা খানের নামানুসারে বগুড়া জেলার নামকরণ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
বগুড়া জেলা শহরে অবস্থিত কারুপল্লী এক সময়কার খুব জনপ্রিয় একটি স্থান। প্রথমবার বগুড়ায় এসে কারুপল্লীতে এসেছিলাম। নবাববাড়ী বা নবাব প্যালেসেও ঢুঁ মারা হয়েছে তখন। বগুড়ার নবাবদের মধ্যে নবাব আব্দুস সোবহান চৌধুরী, নবাব আলতাফ আলী চৌধুরী এবং নবাব মোহাম্মদ আলী অন্যতম। নবাব মোহাম্মদ আলী এক সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। নবাব বাড়িটিকে এখন জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। শহরের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান এডওয়ার্ড পার্ক, জৈন মন্দির, ব্রাহ্মসমাজ মন্দির, গির্জা ও ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্ক। একথা নিঃসন্দেহে বলবো, যারা ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন তাদের জন্য একটি আদর্শ স্থান বগুড়া।
বগুড়ার প্রত্মতত্ত্ব নিদর্শনের অন্যতম আকর্ষণ মহাস্থানগড়। প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন মহাস্থানগড় বা পুন্ড্রনগরী। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ অব্দে মৌর্য শাসনামলে এই নগরীর পত্তন হয়েছিলো বলে গবেষকরা ধারণা করেন। মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন হয়ে নগরীর কর্তৃত্ব আসে মুসলমানদের হাতে। বগুড়া শহর হতে প্রায় ১৪ কি.মি. উত্তরে বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের পাশেই মহাস্থান গড়ের অবস্থান। ২ কি.মি. এর অধিক জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই দূর্গ নগরীর উত্তরে, পশ্চিমে ও দক্ষিণে প্রায় অর্ধ বৃত্তাকারে ১০ কি.মি. পরিধি বিশিষ্ট প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে বিখ্যাত চৈনিক পর্যটক উয়ান চাং পুন্ড্রনগরী ভ্রমণ করেন। নগর দুর্গের বাইরে শহরতলীতে বহু সংখ্যক সম্ভ্রান্ত নাগরিকের বসবাসকেন্দ্রসহ পরিখা, বাজার, মন্দির প্রভৃতির সন্ধান পাওয়া গেছে। নগর দুর্গে ছিল রাজকীয় প্রাসাদ আর রাজাদের বাসস্থান। মহাস্থানগড়ে যতোবার আসি ততোবারই যেনো সবকিছু নতুনভাবে দেখি। পুরাতনকে দেখার সাথে যুক্ত হয় একেবারে নতুন কিছু। যেনো একটি মহাগ্রন্থ পাঠ করার অভিজ্ঞতা। বারবার অধ্যয়নেও যার আকর্ষণ কখনো ফুরোয় না। পুন্ড্রনগরীর অনতিদূরেই একটি স্থান গোকুল মেধ বা কথিত বেহুলার বাসরঘরের অবস্থান। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ হতে সপ্তম শতকের মধ্যে এই ‘মেধ’ নির্মাণ করা হয়। পোড়ামাটি দ্বারা নির্মিত ১৭২টি কক্ষবিশিষ্ট ত্রিকোণাকার এই স্থাপনাটি পূর্ব পশ্চিমে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ। এই স্থাপনাটিকে বেহুলার বাসরঘর হিসাবে শিবভক্ত সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও পূজা অর্জনা করে থাকেন। আসলে এটিও একটি বৌদ্ধবিহার।
পুন্ড্রনগরীর পূর্বপাশে আছে শীলা দেবীর ঘাট। এখানে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা দশমীতে দশহরা স্নান উপলক্ষে মেলা বসে। এ ছাড়া প্রতিবছর বৈশাখের শেষ বৃহস্পতিবার শাহ সুলতান বলখীর মাজারসংলগ্ন এলাকায় এক বিশাল মেলা বসে। মেলা দীর্ঘ একমাস চলে। মহাস্থানগড়ের আশেপাশের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে বৈরাগীর ভিটা, মুনীরঘোন, গোবিন্দ ভিটা, জীয়ৎ কুন্ড, মানকালীর কুন্ড, খোদার পাথর ভিটা, মাহী দাওয়ার মাজার, মসজিদ, স্কন্দের ধাপ, ভাসু বিহার, বিহার ধাপ এবং মঙ্গলকোট অন্যতম। মহাস্থানগড়ে একটি সমৃদ্ধশালী জাদুঘর রয়েছে। এতে মৌর্য সভ্যতা হতে মুসলমান শাসনকাল পর্যন্ত সকল সভ্যতার নিদর্শনস্বরূপ বিভিন্ন প্রত্নবস্তু সংরক্ষিত রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাচীনতম নিদর্শনগুলো দেখতে দেখতে কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে আমরা টেরই পাইনি। এবার ফেরার পালা। আমরা মহাস্থানগড় বা পাহাড়পুরের মতো প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোকে সংক্ষিপ্তভাবে কেবল চোখ বুলিয়ে গেলাম। যেনো দ্রুতগামী এক বাহনে চড়ে মুহূর্তেই পেরিয়ে গেলাম আড়াই হাজার পূর্বের সভ্যতার রাজপথ! আসলে এখানে বারবার আসতে হবে। পুনঃ পুনঃ পাঠের মধ্য দিয়ে এই ‘মহাগ্রন্থে’র মাধ্যমে আমাদের জ্ঞানচক্ষু অনেকটা উন্মোচিত হতে পারে। জানা হতে পারে একটি বিলুপ্ত সভ্যতা ও মানুষের সমসাময়িক এবং ভবিষ্যত ভাবনার নানা অনুষঙ্গ। যে ভাবনার উপর আমরাও দাঁড়িয়ে আছি। যে ভাবনাকে সৃজনশীলভাবে এগিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়তো পেতে পারে দিক-নির্দেশনা।