1. admin@channel7bangla24.com : admin :
রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৯ অপরাহ্ন

জাতি পেয়েছিল পিতা হত্যার বিচার

নিউজ ৭ বাংলা ডেস্ক :
  • প্রকাশের সময় : সোমবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৩
  • ৩১৬ বার পঠিত

খায়রুল আলম : বিভীষিকাময় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত। সেদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ওই সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাঙালি তার শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে শোকাভিভূত। রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে রাজপথ ছিল প্রকম্পিত।

এরই মধ্যে ওই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর নতুন একটি আইন জারি করা হলো। যা পরিচিতি পেয়েছিল কুখ্যাত ইনডেমনিটি দেশ হিসেবে। এই আইনের সারমর্ম ছিল জাতির পিতা হত্যার বিচার চাওয়া যাবে না। আইনের শাসনের ইতিহাসে ওই দিনটি একটি কালো দিন। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এরকম কালো আইন আগে ও পরে আর কখনোই ঘটেনি।

সেই ঘৃণিত ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। দেশের প্রধানমন্ত্রী হন তারই কন্যা বর্তমানে টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর ওই বছরই ইনডেমনিটির মতো কালো অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়। প্রমাণ হয় কোনো অন্যায় বা কালাকানুন চিরস্থায়ী হয় না। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসের নৃশংসতম একটি ঘৃণ্য অধ্যায়। ঘাতকের বুলেটে সপরিবারে শহীদ হন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৫ আগস্টের পর রক্তের দাগ তখনও শুকায়নি। এর মাত্র ৪২ দিনের মাথায়, ২৬ সেপ্টেম্বর কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে খুনি খোন্দকার মোশতাক। এই অধ্যাদেশে যে কোনো আদালতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।

‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষর রয়েছে। মোশতাকের স্বাক্ষরের পর অধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর রয়েছে। ইনডেমনিটি

অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ ছিল। এই ভাগের প্রথম অংশে ছিল, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় ভাগে ছিল , রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিচারপতি সাত্তার, জেনারেল এরশাদ এমনকি খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকলেও কোনো সরকারই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেনি। বরং খুনিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
সামরিক স্বৈরাচারের ভোট খেলায় খুনিদের এমপিও বানানো হয়ছে। কুখ্যাত এই অধ্যাদেশে দীর্ঘ ২১ বছর দৃশ্যত থমকে ছিল আইনের শাসন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দরজা খুলে যায়।
১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে সংসদ। পরে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের আইনকে বৈধ বলে রায় দেয়।
এরপরই দায়ের করা হয় জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা মামলা। আইনের আওতায় আনা হয় খুনিদের। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ।
১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। যেহেতু মোশতাক সরকার ছিলো সেনাসমর্থিত। জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাপ্রধান সেহেতু এর দায় তিনি এড়াতে পারেন না।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রকারী হিসাবে আবিভূর্ত হন। সে সময় বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি সায়েম জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং জিয়া রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। সংশোধনীটি পাস হয় ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল। সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিল ‘সংবিধান (৫ম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’ এবং এই সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেওয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা দায়মুক্তি পেয়ে যায়।

খোন্দকার মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বৈধতা দেওয়া না হলে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই ১৫ আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেত। জিয়াউর রহমানই ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, ভবিষ্যতে কেউ যাতে ব্যবস্থা না নিতে পারে সে ব্যবস্থা করে দিলেন এবং ঐ সময়ে একটি প্রোপাগন্ডা ছড়িয়ে গেল যে, যেহেতু এটি সংবিধানের অংশ হয়ে গেছে এটি আর পরিবর্তন হবে না এবং এই দোহাই দিয়েই জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরও বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল বা রহিত করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনিরা ১৫ আগস্টের হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াত। যা জাতি হিসাবে আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক।

প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বলতে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, রাজিব গান্ধী, পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান বেনজির ভুট্টো, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট বন্দর নায়েককে গুলিতে হত্যার পর কোনো দেশেই এমন ন্যক্কারজনক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়নি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল সংক্রান্ত আইনগত দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে যে কমিটি গঠন করা হয়, তাদের রিপোর্টেই প্রকাশ পায় এই কুখ্যাত আইনটি বাতিলের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই।

যুক্তি হিসেবে নানা কারণ উল্লেখ করে কমিটি রিপোর্টে প্রধানত ১৬টি আইনের কথা তুলে ধরে। সেগুলো ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতোই ৫ম সংশোধনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা পরবর্তীকালে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই সংসদে বাতিল করা হয়েছে। কমিটির এই রিপোর্ট আইন কমিশনের মতামতের জন্য পাঠানো হলে সাবেক প্রধান বিচারপতি এফকেএম মুনীরের নেতৃত্বাধীন এই কমিশনও তা সমর্থন করে। এরপর তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বিল বাতিলের জন্য ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬’ নামে একটি বিল উত্থাপন করেন। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বরের ঐতিহাসিক দিনে সংসদে পাস হয় মানবতা ও সভ্যতাবিরোধী কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বিল। ঘোচানো হয় ২১ বছরের জাতীয় কলঙ্ক। যার মাধ্যমে বাতিল হয়ে যায় কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, খুলে যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ।

এদিকে খোন্দকার মোশতাক মন্ত্রী ছিলেন, উপরাষ্ট্রপতি কিংবা স্পিকার ছিলেন না। কাজেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার দায়িত্ব গ্রহণ এবং খুনিদের বাঁচানোর জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। তদুপরি রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ইচ্ছাখুশি যেকোনো বিধান জারি করতে পারেন না। সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ প্রণয়নের ক্ষমতা বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়া অবস্থায় অথবা উহার অধিবেশনকাল ব্যতীত, কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট আশু ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রহিয়াছে বলিয়া সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে তিনি উক্ত পরিস্থিতিতে যেরূপ প্রয়োজনীয় বলিয়া মনে করিবেন, সেইরূপ অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করিতে পারিবেন এবং জারি হইবার সময় হইতে অনুরূপভাবে প্রণীত অধ্যাদেশ সংসদের আইনের ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন হইবে : তবে শর্ত থাকে যে এই দফার অধীন কোনো অধ্যাদেশে এমন কোনো বিধান করা হইবে না, (ক) যাহা এই সংবিধানের অধীন সংসদের আইন দ্বারা আইনসংগতভাবে করা যায় না…’।

কোনো বিধান সংসদের আইন দ্বারা আইনসংগতভাবে করা যায় না সে বিষয়ে সংবিধানের ৭ ও ২৬ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো আইন যদি সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য হয়, তাহলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে। অন্যদিকে ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্য আইন বাতিল। ২৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্য কোনো আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোনো আইন প্রণীত হলে তা মৌলিক অধিকারের কোনো বিধানের সঙ্গে যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক আইন জারি হলেও সংবিধানকে বাতিল করা হয়নি বিধায় সংবিধানের ৩১ এবং ৩২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার, যার দ্বারা আইনের আশ্রয়লাভ এবং জীবনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, সে বিধানসমূহ বলবৎ ছিল।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানের ৩১ এবং ৩২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী হওয়ায় তা শুরু থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাতিল ছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হিসেবে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং সুবিচার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানে বর্ণিত আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার লাভের নিশ্চয়তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধায় সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শুরু থেকেই অসাংবিধানিক ও বাতিল ছিল।

খুনি মোশতাকের অসাংবিধানিকভাবে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা দখল করায় তিনি ছিলেন অবৈধ রাষ্ট্রপতি। একজন অবৈধ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারীকৃত সংবিধানবিরোধী অধ্যাদেশ ছিল আইনের ভাষায় অস্তিত্বহীন ও অবৈধ। সামরিক আইনের আওতায় এই অবৈধ অধ্যাদেশকে জোর করে বহাল রাখলেও ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই অধ্যাদেশটি কার্যকারিতা হারায়। সে সময়ের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ইচ্ছা করলে ১৫ই আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু জিয়া খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, অন্য কেউ যাতে ব্যবস্থা নিতে না পারে সে জন্য দায়মুক্তিকে আরো পাকাপোক্ত করতে দিতে অস্তিত্বহীন, অবৈধ আইনকে সংসদের আইনের মর্যাদা দেন। জিয়া পরবর্তী সময়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে মানবতা, মানবাধিকার, সভ্যতা, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারবিরোধী এই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানের অংশে পরিণত করে নজিরবিহীন ভাবে রক্তমূল্য ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধানকে কলঙ্কিত করেন।

হত্যার বিচার চাওয়ার পথ সাংবিধানিকভাবে রুদ্ধ করে দিয়ে জিয়া বাংলাদেশকে মানবাধিকার ও সভ্যতাবিরোধী অমানবিক, অসভ্য, জংলি রাষ্ট্রে পরিণত করেন। জিয়া খুনিদের দায়মুক্তি অধ্যাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেই থেমে থাকেননি, দূতাবাসে চাকরির যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিশেষ ব্যবস্থায় খুনিদের চীন, আর্জেন্টিনা, আলজেরিয়া, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, ইরান, কুয়েত, আবুধাবি, মিসর, কানাডা ও সেনেগালের বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করেন। জিয়াউর রহমানের পর বিচারপতি সাত্তার, জেনারেল এরশাদ এবং খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকলেও কেউই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেননি। বরং জিয়া খুনিদের দূতাবাসে যে চাকরি দিয়েছিলেন, এরশাদ ও খালেদা জিয়া তাদের পদোন্নতি দিয়ে বাঙালি জাতির কলঙ্কের দায়কে দীর্ঘায়িত করেছেন। দায়মুক্তি পেয়ে ও দূতাবাসে চাকরি-পদোন্নতি পেয়ে খুনিরা ১৫ই আগস্টের হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াতেন।

বিচার চাইবার অধিকার সাংবিধানিক ও সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত। এই স্বীকৃত অধিকারকে স্বৈরাচারী কোনো অধ্যাদেশ দ্বারা রুদ্ধ করা যায় না। আপিল বিভাগের রায়ের পর পরই কারাগারে থাকা দণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ জনের ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয় ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি। সাম্প্রতিক সময়ে আরো এক জন দণ্ডিতকে গ্রেফতার করে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। জাতি কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত হয়েছে; অবসান হয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও গ্লানি। দেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আইনের শাসন।

১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর যেদিন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিত করার জন্য সংসদে আইন পাস হয়, সেদিন বিএনপি ও জামায়াতের সংসদ সদস্যরা সংসদে অনুপস্থিত থাকেন এবং খুনিদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি বাতিলের বিরুদ্ধে হরতাল আহ্বান করেন। ইনডেমনিটি আইন বাতিলকে চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৭ সালে খুনি শাহরিয়ার রশিদ উচ্চ আদালতে যে রিট দায়ের করেছিলেন সে মামলায় শাহরিয়ার রশিদের আইনজীবী ছিলেন খালেদা জিয়া সরকারের মন্ত্রী অ্যাডভোকেট কোরবান আলী। এ মামলায় আদালত বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব উদ্দীন আহমেদকে নিরপেক্ষ পরামর্শ দেওয়ার জন্য আদালতের মিত্র তথা অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দিলে তিনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধ আইন হিসেবে যুক্তি তুলে ধরেন। তার মানে, পরোক্ষভাবে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকে তিনি বৈধ মনে করেন।

এরশাদ খুনিদের রাজনৈতিক দল গঠন ও সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, আর খালেদা জিয়া ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে খুনি শাহরিয়ার রশিদকে সংসদে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচন করেছিলেন। কথায় কথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পুনরাবৃত্তির হুমকি শুনি বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের মুখে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে ‘১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্ট’ নিয়ে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘১৫ আগস্ট এবং ২১ আগস্ট এগুলো কোনো বিষয় না, এ রকম দুর্ঘটনা হতে পারে। এটা নিয়ে সারা জীবন কান্নাকাটির কী আছে?’

এসব ঘটনা প্রমাণ করে মোশতাক-জিয়ার অনুসারীদের অবস্থান পরিবর্তন হয়নি। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কাজ শুরু হয় ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবরে ধানমন্ডি থানায় একটি ফৌজধারী মামলা দায়েরের মাধ্যমে। ১৯৯৮ সালে যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ৮ নভেম্বর ১৫ জন আসামিকে আদালত মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। আসামীপক্ষ উচ্চ আদালতে আপিল দায়ের করলে উচ্চ আদালত ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি এদের মধ্যে ৫ জনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয় এবং ২০২০ সালে পলাতক ক্যাপ্টেন মাজেদ ধরা পরলে তার ফাঁসির রায়ও কার্যকর করা হয়। বিদেশে পলাতক অন্যান্যদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর করার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।

দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া জরুরি। কিন্তু এদেশের মানুষসহ বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পরই মানবতাবিরোধী কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করে বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কোনো সভ্য দেশে ও সমাজে বিচার বন্ধ করে দেয়ার এ ধরনের জঘন্য অধ্যাদেশ/আইন থাকার কথা চিন্তাও করা যায়না। সেনাসমর্থিত ষড়যন্ত্রকারী অকৃতজ্ঞ খন্দকার মোশতাক সরকার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল।

জিয়াউর রহমানসহ বিএনপি সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। ১৯৯৬ সালে সংসদে যেদিন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল আইন পাস হয় সেদিন বিএনপি হরতাল ডেকেছিল। তারা বলেছিল প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে। অথচ সুযোগ থাকা স্বত্ত্বেও কোনো ট্রাইবুন্যাল বা বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যার বিচার চেয়েছেন দেশের প্রচলিত আইন ও আদালতে। এদেশে একজন সাধারণ নাগরিকের হত্যার বিচার যে প্রক্রিয়ায় হয় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার বিচারও সেই প্রক্রিয়াই হয়েছে।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (বাতিল) আইন, ১৯৯৬ একটি বৈধ আইন হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ থেকে ঘোষিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার তদন্ত ও বিচার দ্রুতগতি লাভ করে। মোট ২০ জন আসামির বিরুদ্ধে ঢাকার দায়রা জজ আদালতে বিচারকার্য শুরু হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।

চার্জ গঠনের পর একজন আসামি হাইকোর্টে রিভিশন দায়ের করে মামলা থেকে অব্যাহতি লাভ করেন। রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক আদালতে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে দেওয়া এক রায়ে ১৯ জন আসামির মধ্যে ১৫ জন আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে সবাইকে ‘মৃত্যুদণ্ড’ প্রদান করেন। অন্যদের খালাস প্রদান করেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৩৭৪ অনুযায়ী বিচারিক আদালত প্রদত্ত ‘মৃত্যুদণ্ড’ আদেশ অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে রেফারেন্স পাঠানো হয়। হাইকোর্ট বিভাগের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জ্যেষ্ঠ বিচারপতিগণ এই ডেথ রেফারেন্স শুনানিতে বিব্রত বোধ করেন। তাদের এমন অপ্রত্যাশিত মানসিকতা কিছুটা হলেও সর্বোচ্চ আদালতের ভাবমূর্তিতে কলঙ্কতিলক এঁকেছিল। অবশেষে বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ও বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে এই ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হয়। শুনানি শেষে বেঞ্চের একজন বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন এবং একজন আসামির দণ্ডাদেশ পরিবর্তন এবং পাঁচ জনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে খালাস প্রদান করেন। কিন্তু অপর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ১৫ জন আসামিরই মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে তা অনুমোদন করেন। এর ফলে সংগত কারণে ডেথ রেফারেন্সটি তৃতীয় বেঞ্চে গড়ায়। তৃতীয় বেঞ্চের বিচারক হিসেবে বিচারপতি ফজলুল করিম ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশের সাজা বহাল রেখে তিন জনকে খালাস প্রদান করেন।

এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে কারাগারে আটক দণ্ডিত পাঁচ জন পৃথক পৃথকভাবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ‘লিভ পিটিশন’ দাখিল করলে আপিল বিভাগে ‘লিভ’ মঞ্জুর হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে আপিল বিভাগে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের শেষ ধাপ থমকে যায়। আপিল শুনানির জন্য আপিল বিভাগে প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিচারক নিয়োগ না দিয়ে কৃত্রিমভাবে বিচারকসংকট তৈরি করে রাখা হয়।

অবশেষে দীর্ঘ আট বছর পর ২০০৯ সালে আবারও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে আপিল বিভাগে নতুন বিচারপতি নিয়োগের মাধ্যমে আপিল শুনানি সম্ভব হয় এবং ওই আপিলের নিস্পত্তি করা হয়।

‘বিলম্ব কোনো অপরাধীর বিচারে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না’—এই আইনি নীতিটি আবারও স্বীকৃতি পায়। বিচার চাইবার অধিকার সাংবিধানিক ও সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত। এই স্বীকৃত অধিকারকে স্বৈরাচারী কোনো অধ্যাদেশ দ্বারা রুদ্ধ করা যায় না। আপিল বিভাগের রায়ের পর পরই কারাগারে থাকা দণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ জনের ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয় ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি। সাম্প্রতিক সময়ে আরো এক জন দণ্ডিতকে গ্রেফতার করে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। জাতি কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত হয়েছে; অবসান হয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও গ্লানি। দেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আইনের শাসন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়েই জাতি দেখতে পেলো মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার রাজাকার আলবদর বাহিনীর সদস্যদের বিচার।
আর এক সময়ের তলাবিহীন ঝুড়ি খ্যাত বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।

Facebook Comments Box
সংবাদটি শেয়ার করুন :
এ জাতীয় আরও খবর

ফেসবুকে আমরা