সাহিত্য ডেস্ক: আজকের মেঘটা অনেক স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। ইমন মাত্র ইউনিভার্সিটি থেকে এলো। এসেই বিছানায় গা ভাসিয়ে দিলো। এর মধ্যে সায়রা খাতুন রুমে আসেন, ‘যত দিন যাচ্ছে আরও বেহায়া হয়ে যাচ্ছিস! এইটা কোনো শোয়ার সময় হলো?’
‘উফ! বিরক্ত করো না তো। একটু রেস্ট করতে দাও।’
‘কোন কাজ না থাকলে বাবার সাথে কিছু সময় গল্প করলেই পারিস।’
‘হ্যাঁ, তোমার সাথেও কিছু দরকারি কথা ছিল।’ বলে ইমন গোসল করতে চলে যায়।
সায়রা খাতুন রান্নাঘরে রাতের খাবার তৈরি করছেন। ইমন এসে বলল, ‘মা কিছু টাকা দিতে পারবে? বন্ধুরা সবাই মিলে ঠিক করেছে সেন্টমার্টিন যাবে।’
সায়রা খাতুন অবাক হয়ে বলেন, ‘তুই কি ঘরের অবস্থা কিছুই জানিস না?’
ইমন বলল, ‘এ আর নতুন কি, এ ঘরে কখনো আমার কোনো ইচ্ছে পূরণ হবে না। তা বলে দিলেই পারো।’
সায়রা খাতুনের মনটা খারাপ হয়ে গেল।
আতাউর রহমান সকালবেলা খবরের কাগজ পড়ছেন। চা নিয়ে গেলেন সায়রা খাতুন। চায়ের কাপ হাতে দিতেই বলে উঠলেন, ‘কই, আজ ছুটির দিনেও ছেলেমেয়েকে দেখছি না যে?’
‘ইমন গেল বন্ধুদের সাথে দেখা করবে বলে আর শামা ছাদে।’ জানালেন সায়রা খাতুন।
আতাউর রহমান একাই সংসারের ব্যয় বহন করেন। সারাজীবন কাজ করতে করতে শরীরটা আগের মতো নেই। কাজ করার জন্যও আগের সেই ক্ষমতা নেই। সায়রা খাতুনকে বলেন, ‘তা ইমন কী জানি বলবে বলে আর বলল না। তুমি কিছু জানো?’
‘বন্ধুদের সাথে নাকি সেন্টমার্টিন যেতে চায়।’
‘তা তুমি কী বলেছ?’
‘কী আর বলবো, ঘরের অবস্থা কি জানো না? এত অভাব-অনটনের মধ্যে ওকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই। তার ওপর তোমার চিকিৎসাও চলছে।’
আতাউর রহমান বলেন, ‘ছেলেটা কখনো কিছুই চায় না। যা চায় তা-ও আমরা পূরণ করতে পারি না। সারাজীবন কাজ করেও তাদের জন্য কীইবা করতে পেরেছি? না পেরেছি নিজের ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে। তুমি বরং একটা কাজ করো, আমার চিকিৎসার সঞ্চয় থেকে কিছু টাকা দিয়ে দাও।’
‘কিন্তু…’
‘আমার অনেক ইচ্ছে ছিল, বাবার সাথে একবার সেন্টমার্টিন ঘুরে আসবো কিন্তু সেটি কখনো হয়ে উঠল না। আমি চাই না ইমন আমার মতো জীবন কাটাক।’ বলেই আতাউর রহমান নড়েচড়ে বসলেন।
‘কী হলো শরীর খারাপ করছে?’
আতাউর রহমান বমি করতে শুরু করলেন। ডাক্তার ডাকা হলো। ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দেওয়া হলো।
সন্ধ্যা নেমে এলো। ইমন আর সায়রা খাতুন জোছনার আলোয় নিরাশ হয়ে বসে রইলেন। সায়রা খাতুন চিন্তা করতে লাগলেন, এত এত অভাবের মধ্যে কীভাবে কালকে টাকাটা দেওয়া যায়। তার ওপর আতাউর রহমানের শরীর খারাপ করেছে। ইমন গম্ভীর সুরে বলতে লাগলো, ‘আচ্ছা মা, বাকিরা যে খুশিগুলো সহজে পেয়ে যায়; সেই ছোট ছোট খুশিগুলো পেতে আমাকে এত কষ্ট আর পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয় কেন? এবারও আমার টাকার জন্য যাওয়া হবে না। মাঝে মাঝে জীবনটা একটি পরীক্ষাক্ষেত্র মনে হয়।’
সায়রা খাতুন ভ্রূ কুচকে ইমনকে বলেন, ‘কোন পরীক্ষা দিয়েছিস বল তো? লোকটা পুরোজীবন তোদের জন্য খেটে মরলো আর দিনশেষে তোর দুঃখ তোর কাছে অনেক বড় হয়ে গেল? পেরেছিস এই বয়সে বাবার আশ্রয় হতে? বা কখনো লোকটার পা দুটির দিকে তাকিয়েছিলি? থাক চিন্তা করার দরকার নেই, তোর মামার কাছ থেকে ধার নিয়ে তোকে দিয়ে দেবো কাল সকালে।’
ইমনের আর কিছু ভালো লাগছে না। সে উঠে গিয়ে বাবার রুমে ঢুকল। চেয়ারে বসামাত্র তার নজর গেল বাবার পায়ের দিকে। পরক্ষণে ইমনের চোখে পানি জমে উঠলো। অনর্গল পানি পড়ছে। বুকের ভেতর কেমন করে জ্বলে উঠলো। আতাউর রহমানের পায়ের গোড়ালি ফেটে গেছে। আঙুল বেঁকে গেছে। কড়া ওঠার কারণে হাঁটার সময় পায়ে ব্যথা হয়। বাবার পা দুটি দেখতে তার ইচ্ছে করছে না। ইমন চোখের পানি ধরে রাখতে না পেরে বের হয়ে গেল।
আকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করতেই ছোটবেলার দিনগুলো ভেসে ওঠে। যখন বাবা সাইকেলে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন। নিজে নতুন জুতা না পরে তাকে পরাতেন। তাকে সাইকেল কিনে দিয়ে নিজে সারাজীবন পায়ে হেঁটে কাজে গেছেন। বাবা যে তার জন্য সব ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আজ বাবাকে জড়িয়ে ধরে ইমনের খুব কান্না করতে ইচ্ছে করছে। ইমন ভাবে, ‘যে সুখ ও আনন্দ আমি খুঁজে চলেছি। তা বাবার ত্যাগের কাছে কিভাবে বড় হয়ে গেল। জীবনের আসল উদ্দেশ্য আর আনন্দ বুঝতে আমার এত দেরি হয়ে গেল?’
আতাউর রহমানের শরীর আর পা একটু সেরে উঠেছে। ইমন এক কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। আতাউর রহমান ছেলেকে দেখে বসতে বলেন। শামাকে আরেকটি চা করে আনতে বললেন। ইমনকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এই দুই মাসে কিছুই জানা হলো না তোদের ব্যাপারে; কেমন চলছে পড়াশোনা?’
‘হ্যাঁ, বেশ ভালো। তোমার শরীর কেমন আছে?’
‘এই তো ভালো থাকার চেষ্টা করছি কোনোভাবে।’
ইমন বাবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা তোমার সেন্টমার্টিন কেমন লাগে?’
আতাউর রহমান বলেন, ‘শুনেছি অনেকে সুন্দর কিন্তু কখনো যাওয়া হয়নি। তাই জানি না দেখতে ঠিক কেমন। তবে দেখার প্রচুর শখ ছিল।’
‘তুমি কি জানো কালকে আমি সেন্টমার্টিন যাচ্ছি? এবার শেষমেষ যাওয়ার ব্যবস্থা করেই ফেললাম।’
‘সে কি! জানি না তো। তা টাকা জোগাড় করলি কীভাবে?’
‘বলেছিলাম না একটা টিউশনি করাই। সেখান থেকে জোগাড় হয়েছে। দুজন যাচ্ছি।’
‘শুনে ভালো লাগলো, তবে দুজন কে কে?’
‘আমি আর আতাউর রহমান।’
আতাউর রহমান অবাক দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। ইমন বাবার হাত ধরে বলে, ‘কেন বাবা, তুমি আমার সাথে গেলে কি কোনো সমস্যা?’
আতাউর রহমানের মনে হচ্ছে, এই তো তার ছেলে তার পাশে আছে। চোখে জল নিয়ে ইমনকে জড়িয়ে ধরেন। ইমনও বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘চলো এবার একসাথে সেন্টমার্টিন উপভোগ করি।’